জিন তাড়ানোর নামে নির্মম নির্যাতন : শোনেনি মায়ের কান্না

বহিরাগত ওঁঝা ডেকে চুয়াডাঙ্গা গাড়াবাড়িয়ায় সাজ্জাদ মিস্ত্রি ও এক নারীর অর্থবাণিজ্য

 

কামরুজ্জামান বেল্টু: মারতে মারতে যখন মৃত প্রায়, লুটিয়ে পড়ে মাটিতে তখন ২৪ বছরের আমিনুর রহমানকে তুলে হাসপাতালে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। জিন তাড়ানো ভণ্ড ওঁঝা ও তার নারী সহযোগীকে মারতে রুখে যায় গ্রামবাসী। কৌশলে পালিয়ে কবির নামের ওই কবিরাজ প্রাণে রক্ষা পেয়েছে। তার নারী সহযোগী চুয়াডাঙ্গা গাড়াবাড়িয়া বাগানপাড়ার রাজিয়া খাতুন ক্ষণিকের জন্য গাঢাকা দিলেও তার বিরুদ্ধে ফুঁসতে থাকে জনতা। আর ভণ্ড কবিরাজের আশ্রয়দাতা গাড়াবাড়িয়া বাগানপাড়ার বাইসাইকেল মিস্ত্রি সাজ্জাদ? তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি স্থানীয়দের।

মুমূর্ষু অবস্থায় আমিনুর রহমানকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সে ঝিনাইদহ মহেশপুরের মাতরাইজ গ্রামের মৃত রবিউল ইসলামের ছেলে। তাকে সুস্থ করার জন্য তারই মা আছিয়া বেগম গতপরশু সন্ধ্যায় পৌঁছান চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের শঙ্করচন্দ্র ইউনিয়নের গাড়াবাড়িয়া বাগানপাড়ার বাইসাইকেল মিস্ত্রি সাজ্জাদের বাড়িতে। ওই সাজ্জাদ খবর দেন ভণ্ড ওঁঝা মেহেরপুরের কবিরকে। কবির তার এক সহযোগীকে সাথে নিয়ে সাজ্জাদের বাড়িতে পৌঁছান। শুরু হয় দাম দর। আমিনুর রহমানের গায়ে খারাপ জিন ভর করেছে বলে ভুয়া যুক্তি দেখিয়ে তা তাড়ানোর নামে দাবি করা হয় ১৫ হাজার টাকা। সেখানে ডাকা হয় তাদের নারী সহযোগী গাড়াবাড়িয়া বাগানপাড়ারই আব্দুর রাজ্জাকের মেয়ে রাজিয়াকে। আমিনুরের মা আছিয়া বেগম অতো টাকা এখনই দিতে অপারগতা প্রকাশ করে এখন ১ হাজার টাকা বাকি ১৪ হাজার টাকা আগামী চৈত্র মাসে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন।

আছিয়াসহ গাড়াবাড়িয়া বাগানপাড়ার প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই বলেছেন, আমিনুর রহমানের ওপর ভরকরা জিন তাড়ানোর নামে সকাল ১১টার দিকে শুরু হয় ঝাঁড়ফুঁক। এর একপর্যায়ে আমিনুরের গালে থাপ্পড় মারতেই আমিনুরও পাল্টা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় কবিরাজের মুখে। এরপর কবিরাজ উপস্থিত সকলকে বলে, বড় বদমাইশ জিন। তোমরা সকলেই ধরো। এরপর ডালিম গাছের সরু ডাল দিয়ে শুরু হরদম পিটুনি। মারে আর কবিরাজ জানতে চায়, ‘বল তোর নাম কি? বল তোর নাম কি। কোথা থেকে এসেছিস?’ কিছুতেই কিছু নয়। আমিনুর মার খেতে খেতে কাবু হয়ে যায়। একপর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দৃশ্য দেশে আমিনুরের মা কান্না শুরু করেন। সেদিকে তেমন কারোরই ভ্রুক্ষেপ হয়নি। উপস্থিত সকলে জিন তাড়ানোর নামে নির্মম মারপিটের দৃশ্য দেখতে থাকেন। তখনও উপস্থিত কেউ বুঝতে পারেননি জিন তাড়ানোর নামে যা করা হচ্ছে তা ওর ওপর নির্যাতন।

নির্মম নির্যাতনের আমিনুর রহমান যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মুখের দুটি দাঁত ভেঙে শুরু হয় রক্তক্ষরণ। তখন কবিরাজ কবিরসহ তার নারী সহযোগী রাজিয়া গলায় বুকে পা তুলে দিয়ে নির্যাতন করতে থাকে। একপর্যায়ে উপস্থিত কেউ কেউ প্রতিবাদ করতে শুরু করলে ওঁঝা-কবিরাজ নমনীয় হতে থাকে। অবশেষে মুমূর্ষু অবস্থায় আমিনুরকে উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়।

হাসপাতালে ভর্তির সময় ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আছিয়া খাতুন বলেন, আমার ৪ ছেলের মধ্যে বড় ছেলে আমিনুর। মৃগি বেরাম আছে। ছোটবেলা থেকেই সরল সোজা। আমরা দরিদ্র। তার ওপর আমিনুর সরলসোজা অল্প বুদ্ধির। দিনমজুরিও খাটে। মৃগি বেরাম আছে। এ রোগ সারার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। শেষে আমারই এক ভাই ইয়াকুবের মাধ্যমে শুনলাম চুয়াডাঙ্গা গাড়াবাড়িয়ার সাজ্জাদ মিস্ত্রির বাড়িতে নাকি বৃহস্পতিবার বার হয়। সব রোগ সারে। এজন্য একদিন আগেই এসে উঠি। মেহেরপুর থেকে ওঁঝাও আসে। ১৫ হাজার টাকা দাবি করে। ১ হাজার টাকা পরিশোধ করে ১৪ হাজার টাকা চৈত্র মাসে দেবো বলে জানায়। ওঁঝা রাজি হয়ে শুরু করে ঝাঁড়ফুঁকের নামে মারপিট। কতোবার বারণ করেছি। শোনেনি। মারতে মারতে মেরেই ফেলেছিলো প্রায়। আমিনুর যখন মাটিতে পড়ে গুংরাচ্ছে তখন ওই ওঁঝা কবির আর রাজিয়া গলায় ও বুকের ওপর পা দিয়ে চেপে তুলে বলতে থাকে খুব খারাপ জিন। এর আগে ওরা ছেলের মুখের মধ্যে হাড় দিয়ে মারপিট করার সময় দুটি দাঁতও ভেঙে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন বলেছেন, জিন তাড়ানোর নামে ওঁঝা ও তার সহযোগীরা যা করেছে তা বর্ণনা করা যাবে না। প্রথম দিকে বুঝতে না পারার কারণে ভণ্ডদের ভণ্ডামি দিনভর চলেছে। প্রথমেই গ্রামের সচেতন যুবসমাজ বিষয়টি বুঝতে পারলে ওঁঝা ও তার সহযোগীদের উচিত শিক্ষা দিতো। যুবসমাজ যখন বিষয়টি টের পায় তখন ওঁঝা সটকে পড়ে। তার সহযোগীরাও কৌশলে গাঢাকা দেয়। এরপর অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, ওই বাইসাইকেল মেকানিক সাজ্জাদ ও তার প্রতিবেশী রাজিয়া খাতুন বাড়িতে  বহিরাগত ওঁঝা ডেকে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা দিয়ে অর্থবাণিজ্য শুরু করেছে। প্রতি বৃহস্পতিবার বার বসিয়ে হাত চালানোর নামে যেসব নাটক শুরু করেছিলো তার উপযুক্ত বিচার হওয়া দরকার। জিন দিয়ে বাড়ির লোকজনকে ক্ষতি করবে হুমকির কারণে সাজ্জাদ মিস্ত্রির বাড়ির পাশের লোকজন কিছু বলতে সাহস পায় না বলেও অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।