আগ্রাসী নতুন সর্বগ্রাসী : অসহায় মানুষ

ভ্যান-রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের দ্বিবার্ষিক নির্বাচন না হওয়ায় ক্ষোভ

 

কামরুজ্জামান বেল্টু: চুয়াডাঙ্গা রেলপাড়ার আব্দুল হান্নানের সেই ছোটবেলায় রিকশা চালানো শুরু। তখন হাফপ্যান্ট পরতেন। এখন বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে কয়েক বছর আগে। শুরুতে ৫ টাকায় রিকশাভাড়া নিয়ে ২৫ থেকে ৩০ টাকার ভাড়া মেরে বাড়ি ফিরতেন। পরবর্তীতে রিকশা নিতে হতো ১০ টাকা দিয়ে। ১৩-১৪ বছরের মাথায় বিয়ে করে নিজেই রিকশা কেনেন। সেই রিকশা এখনও আছে। তবে প্রথম সেই বউ আর কাছে নেই। ফিরেছে বাপের বাড়ি গোপিনাথপুর। দ্বিতীয় বিয়ে করে পৈত্রিক সেই জীর্ণকুঠিরেই কাটছে বর্তমান দিনকাল।

চুয়াডাঙ্গার রাস্তায় রিকশা বেশ কিছুদিন ধরেই অতীত হতে বসেছে। যেমন অচেনা হয়ে গেছে ঘোড়ার গাড়ি। দুলদুলে টানা সেই গাড়ি হটিয়ে প্যাডেল চেপে মানুষের টানা ভ্যান দখল করে শহরের রাজপথ। প্যাডেল ঘুরিয়ে সওয়ার-মালামাল টানা ভ্যান-রিকশাও অতীত হতে বসেছে। সড়কগুলো মূলত বর্তমানে ব্যাটারিচালিত ইজি বা অটোবাইকের দখলে। ইতিহাস হতে বসা প্রবীণ চালকদের বর্তমান দিনকাল জানতে গতকাল শহরের বেশ কিছু রিকশাচালকের সাথে কথা বলতে গেলে পাওয়া যায় বিচিত্র তথ্য। প্রবীণ রিকশাচালকদেরই একজন আব্দুল হান্নান। তার সাথে কথা বলতে গেলে তিনি রিকশা ছেড়ে ইজিবাইক চালক হতে খুব একটা আগ্রহী নন। কেন? বয়সের ভারে নূয়ে পড়া মানুষটার হরেক রঙের কষ্ট। তিনি বলেন, প্রথম স্ত্রী অন্যের হাত ধরে চলে গেছে। দু ছেলে। বড় ছেলে তার নানাবাড়ি দোকানদারি করে। ছোট ছেলে শিখছে ছুতোর মিস্ত্রির কাজ। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে কোনো রকম কেটে যাচ্ছে দিনকাল।

চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরে কয়েক হাজার রিকশা চলতো। এখন? কমতে কমতে কয়েকশতে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গে চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনের চা দোকানি জমির উদ্দীন বললেন, এইতো দু বছর আগেও স্টেশনে প্রায়শ খানেক রিকশা সারিবদ্ধ থাকতো। এখন থাকে অটো। হাতে গোনা রিকশা চলে শহরে। রাতে বেশ কিছু রিকশা চলে। ওতে ব্যটারি লাগিয়ে অটোতে রূপান্তর করা।

অপরদিকে আবারও রিকশাচালক শ্রমিকদের নির্বাচনের দাবি উঠেছে। রিকশা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আশাদুল হক অভিযোগ করে বলেছেন, দু বছর অন্তর ভোট হওয়ার কথা। হয় না। ২০০৯ সালে ভোট হযেছে। ভোটের পর অর্থ তছরূপই শুধু করা হয়নি, নির্বাচন না দিয়ে সভাপতি শফিকুল ইসলাম ও সেক্রেটারি লিয়াকত আলী কমিটিটাই কুক্ষিগত করে রেখেছেন। এ বিষয়ে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকতের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এক সময দু তিন হাজার সদস্য ছিলো। কার্ডও দেয়া হয়েছে ২২৭৬টি। কিন্তু রিকশা কমতে কমতে এখন এমন এক পর্যায়ে তা হতাশাজনক। ভোট হয় না কেন? ২০১৪ সাল থেকে ত্রিবার্ষিক কমিটি করা হয়েছে। নির্বাচনের সময় কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন না বলে আমরাই রয়েছি। তবে খুব শিগিগিরই নির্বাচন তফশিল ঘোষণা করা হবে। পক্ষান্তরে আশাদুল হক বলেছেন, নির্বাচনের দাবিতে আগামী শুক্রবার বিকেল বাসটার্মিনালে রিকশাচালকদের সভা আহ্বান করা হয়েছে।

পুরাতনকে ছেড়ে নতুনকে মেনে নিতে নানা রকম কষ্ট হয়। তারপরও নতুনেরই জয় হয়। কালের বিবর্তনের ধারা তাই বলে। ঘোড়ার গাড়ি তাড়িয়ে রিকশা, রিকশা তাড়িয়ে এখন অটো। এরপর? হয়তো সোলার শক্তিতে উড়ন্ত কোনো যানবাহন আসবে মানবজাতির সেবায় নিয়োজিত হতে। এরকমই মন্তব্য করে জেলার অভিজ্ঞ সচেতন মহল বললেন, রিকশা-ভ্যানের আকার পরিধি আড়ে বেড়ে খাটো হওয়ার কারণে শহরে তেমন যানজট দেখা যেতো না। এখন সড়কে ডিভাইডার হযেছে, রিকশা হটিয়ে অটো এসেছে। অটোর আকার আয়তন যেমন বেড়েছে তেমনই চালকদের অদক্ষতায় পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এ থেকে পরিত্রাণ? কে করবে প্রতিকার? এসব প্রশ্ন তুলে কষ্ট না বাড়িয়ে বরঞ্চ রেলপাড়ার আব্দুল হান্নানের মতো সব কিছু মেনে নেয়ার মানসিকতা গড়তে পারলেই জনম পার। তা না হলে যানজটের জঞ্জাল শহর ছেড়ে পালাতে হবে গ্রামে। যদিও গ্রামবাংলায় শহর, শহরতলীতে শ্যালোইঞ্জিনচালিত যন্ত্রদানব দাঁত খিঁচিয়ে মানুষ খাচ্ছে রোজ।