ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে রিমুর সহপাঠীরা : তাদের বহুভাগে বিভক্ত করতেও কটুকৌশল

 

পরীক্ষা হলে কর্তব্যরত শিক্ষিকার ফোনে রিং আসতেই তিনি বের হন বাইরে : ফিরে হইচই শুনে অনুমানের ভিত্তিতে শাস্তি দেন রিমুর

স্টাফ রিপোর্টার: প্রাইভেট না পড়লে দেখে নেবো কী করে পাস করিস, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে এ হুমকি যেমন অতীব পুরোনো, তেমনই বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছে প্র্যাকটিকেলে ফেল করিয়ে দেয়ার হুমকি নতুন নয়। এরই মাঝে চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী সুরাইয়া সুলতানা রিমুর আত্মহুতির পর প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষকদের কটুকৌশল হিসেবেই খাতা কেড়ে নেয়ার প্রসঙ্গটি সামনে আসে। অবশ্য সময় গড়ানোর সাথে সাথে আভিযোগের ধরণ যেমন পাল্টাচ্ছে তেমনই অভিযোগকারীদের বহুভাগে বিভক্ত করে বিভ্রান্ত সৃষ্টিতে সিদ্ধহস্ত এখন কয়েকজন শিক্ষক।

শুধু চুয়াডাঙ্গা সরকারি বলিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকই নয়, নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে নানা কটুকৌশলে বাধ্য করা হয়। গত শনিবার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির ছাত্র রিমু গণিত পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি চুয়াডাঙ্গা সবুজপাড়ায় ফিরে বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকে। গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। গণিত পরীক্ষার খাতা শিক্ষক কেড়ে নেয়ার কারণেই আত্মহত্যা করে সে। বিষয়টি পরদিন তার সহপাঠীরা জানার পর বিদ্যালয়ের সামনে শহীদ আবুল কাশেম সড়কে অবস্থান নিয়ে শিক্ষক হাসানুজ্জামান ও আমিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করানোর অভিযোগ তুলে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কয়েকজন উপস্থিত হন ঘটনাস্থলে। অপরদিকে প্রকাশ্যেই শিক্ষক আমিরুল আন্দোলনরত ছাত্রীদের হুমকি দিয়ে বলতে থাকেন তোমরা আন্দোলন করছো করো, কীভাবে তোমরা ক্লাস টেনে ওঠো সেটা দেখবো। এ হুমকিতে আন্দোলনরতর শঙ্কিত হয়ে পড়ে ছাত্রীরা। বিষয়টি জানার পর পাশেই থাকা ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার বেলায়েত হোসেনকে জানান এক অভিভাবক। হুমকির বিষয়ে তাৎক্ষণিক অভিযুক্ত শিক্ষককে ডেকে কেন হুমকি দিয়েছেন? জানতে চাইলে শিক্ষক বলেন হুমকি নয়, মেয়েদের খারাপ বলেছি। তখন পুলিশ সুপার শিক্ষকের খারাপ শব্দের প্রতিবাদ জানিয়ে শিক্ষককে শিক্ষক সুলভ আচরণের তাগিদ দেন। অপরদিকে আন্দোলনরত সহপাঠীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত হয় ৫ সদস্যের তদন্ত টিম। এ টিমের প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আব্দুর রাজ্জাককে। তিনি তদন্ত করে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবেন। এদিকে রিমুর সহপাঠীদের বিভক্তি করে কয়েকজন শিক্ষক বিভ্রান্ত সৃষ্টির চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছেন। গতকাল বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির কয়েকজন ছাত্রীর সাথে কথা বলতে চাইলে তারা ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেও পরশুর মতো মুখ খুলতে চায়নি। যে ক’জন কথা বলেছে তাদের প্রত্যেকেরই মনে হয়েছে কয়েক শিক্ষকের শেখানো কথা বলছেন। তবে গোপনে শিক্ষার্থীদের প্রায় সকলেই বিদ্যালয়ের প্রাইভেট পড়নো শিক্ষকদের নানা কটুকৌশলের অভিযোগ তুলে বলেছে, প্রাইভেট না পড়লে নম্বরই শুধু কম দেয়া হয় না শ্রেণিকক্ষেও কটূক্তি করা হয়।

গণিত পরীক্ষার সময় রিমুর কক্ষে থাকা কয়েকজন ছাত্রী অবশ্য গতকাল বলেছে, গত শনিবারে ১ নম্বর রুমে গণিত পরীক্ষা দিচ্ছিলো রিমু। কক্ষ পরিদর্শক হিসেবে ছিলেন সহকারী শিক্ষক ওয়াহিদা পারভীন পপি। এ সময় শিক্ষক পপির মোবাইলফোনে রিং আসে। তিনি কথা বলার জন্য কক্ষের বাইরে চলে যান। কথা শেষ করে শিক্ষক পপি যখন হলে ঢোকেন তার কানে কথা বলার শব্দ আসে। তিনি অনুমান করে রিমুর খাতা কেড়ে নেন এবং দাঁড় করিয়ে রাখেন। রিমুকে খাতা ফেরত দেয়ার পর রিমু আর পরীক্ষায় মনোনীবেশ করতে পারেনি। এই যন্ত্রণায় কাল হয়ে দাঁড়ায় রিমুর জীবনে। রিমুর সহপাঠী বান্ধবীদের অভিযোগ, ‘ম্যাডাম আন্দাজেই রিমুর খাতা কেড়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। কিন্তু রিমু কারো সাথে কোনো কথা বলেনি। নিরপরাধ রিমুর খাতা কেড়ে দাঁড় করিয়ে না রাখলে সে অকালে ঝরে যেতো না।’ তারা অভিযোগ করেছে ‘প্রাইভেট পড়ানোর জন্য আমাদেরকে বাগে আনতেই শিক্ষক হাসানুজ্জামান জটিল প্রশ্ন তৈরি করেন। সিলেবাসের বাইরে থেকেও প্রশ্ন দেয়া হয়। এসবেরই শিকার আমাদের বান্ধবী রিমু।’ খাতা কেড়ে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখার বিষয়টি স্বীকার করে অভিযুক্ত শিক্ষিকা ওয়াহিদা পারভীন পপি বলেন, কথা বলার কারণে পাঁচ মিনিট তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম।

গতকাল সোমবার সরেজমিনে বিদ্যালয়ে গেলে সাধারণ ছাত্রীরা অভিযোগ করে বলেছে, রিমু মারা যাওয়ার পর আন্দোলনের কারণে শিক্ষকরা পরীক্ষার হলে আমাদের পানে কোনো আমল দিচ্ছেন না। তারা বলছেন, তোমরা যা ইচ্ছে করো আমরা কিছু বলবো না। এ ব্যাপারে প্রধান শিক্ষক এসএম আসগর আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি মাথাভাঙ্গাকে বলেন, কয়েকজন ইতোমধ্যেই চুয়াডাঙ্গা থেকে অন্যত্র বদলি হতে তদবির শুরু করেছেন। এ স্কুলের পরিবেশ তাদের কাছে ভালো মনে হচ্ছে না। রিমুর নামে একটি কক্ষের নামকরণের বিষয়ে প্রধান শিক্ষক জানান, ছাত্রীদের দাবির প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে। আমরা মনে করছি রিমু যে কক্ষে শেষ পরীক্ষা দিয়ে গেছে সেই কক্ষের নামটিই রিমুর নামে করবো। তবে এ ব্যাপারে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। এদিকে যে হলে রিমু শেষ পরীক্ষা দিয়েছিলো সেই কক্ষের নামকরণ রিমুর নামে করার দাবি তুলেছে বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। একই সাথে সুষ্ঠু বিচার না পেলে আবারও আন্দোলনে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছে তারা।

রিমুর বান্ধবী জান্নাতুল মিম্মাসহ কয়েকজন কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারা পরীক্ষার হলে এসে লিখতে পারছে না। রিমু যেখানে বসে পরীক্ষা দিচ্ছিলো সেই সিট খালি দেখে তারা কষ্টে মূহ্যমান হয়ে পড়ছে। লাবণ্য, পৃথিবী, সুমনা, প্রত্যাশা ও মোহনা জানায়, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর আমরা যদি সুষ্ঠু বিচার না পাই তাহলে আবার আন্দোলনে যাবো।

চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের সবুজপাড়ার বাসিন্দা চুয়াডাঙ্গা এসপি অফিসের অফিস সহকারী শরিফুল ইসলাম ও হুসনে আরার একমাত্র সন্তান মেধাবী ছাত্রী রিমু শনিবার সন্ধ্যায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। তার মৃত্যুর জন্য শিক্ষক হাসানুজ্জামান ও ওয়াহিদা পারভীনকে দায়ী করে রোববার ২ ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রিমুর সহপাঠী ও বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। জেলা প্রশাসন ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। সোমবার রিমুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তার পিতা-মাতা শোকে পাথর হয়ে পড়েছেন। রিমুর সহপাঠীরা দলে দলে এসে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে।