মৃত্যুর ২৭ বছরেও নির্মাণ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি ২১শে পদকপ্রাপ্ত উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান মরমী বাউল কবি খোদা বক্শ শাহ্’র সমাধিস্থল

 

রহমান মুকুল: মৃত্যুর ২৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি ২১শে পদকপ্রাপ্ত উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান মরমী বাউল কবি খোদা বক্্শ শাহ’র সমাধীক্ষেত্র। এ বিষয়ে যাদের কিছু করার আছে, তাদের নির্লিপ্ততা ও উদাসীনতায় এখনও সম্পন্ন হয়নি মাজার কমপ্লেক্স। ফলে এ জেলারই কৃতী পুরুষ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাউল সাধকের কৃর্তিসমূহ অবহেলিত হয়ে মুখ থুবড়ে আছে।

লালন ঘরানার অকৃত্রিম গায়ক সাধক খোদা বক্শ শাহ্ ১৯২৮ সালের ৩০ চৈত্র আলমডাঙ্গার পল্লি জাঁহাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। সঙ্গীতপ্রাণ এই মহৎ নিষ্ঠাবান মানুষটির অপরিসীম দরদ ও প্রচেষ্টায় বাংলা সঙ্গীতের মূলবিকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন। লালনের সাধের ‘সহজ মানুষ’ খুঁজতে খুঁজতে একদিন নিজেই হয়ে উঠলেন আলা-ভোলা। সেই কাক্সিক্ষত সহজ মানুষ প্রখ্যাত নজরুল ও উচ্চাহ সঙ্গীত বিশারদ সুধীন দাস যথার্থই বলেন, ‘প্রথম দর্শনের আলাপে তাকে মহর্ষি ব্যক্তিত্ব বলে মনে হয়েছিলো। এক পবিত্র আধ্যাত্মিকভাবে সেদিন তিনি আমাকে অভিভূত করেছিলেন।’

এ প্রসঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লালন গবেষক তৃপ্তি ব্রক্ষ্মের অভিমতটিও প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘খোদা বক্শ শাহ্ ছিলেন উদাসী ভাবুক প্রকৃতির। তাকে দেখে মনে হতো তিনি ঊর্ধ্ব জগতের মানুষ। শুধু কি মানুষ? গায়ক হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। তার কন্ঠে লালনের গান শুনে মনে হতো ওটাই প্রকৃত লালন সঙ্গীত। এছাড়া সমগ্র ভাবসঙ্গীতেরও উস্তাদ শিল্পী ছিলেন তিনি। একতারার রিনিঝিনি এবং বায়ার গুরুগম্ভীর বোল সহসা অভির্ভূত করতো দর্শক-শ্রোতাদের। অপূর্ব গায়কীশৈলী মূহুর্তেই সম্মোহিত করে দিত সঙ্গীত পিপাসুর তৃষ্ণার্ত অন্তর। প্রত্যন্ত পল্লির একজন সাধক ফকিরের গান যে এতো অপরূপ সৌন্দর্য্যে গীত হয়ে মানুষের হৃদয় জয় করতে পারে তার উদাহরণ কেবল খোদা বক্শ শাহ নিজে। শুধু বিরল গায়ক হিসেবেই নন, অজ¯্র ভাবসঙ্গীতের ¯্রােষ্টা হিসেবেও। সাধনার বলে সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠার এমন দৃষ্টান্ত সহজে মিলে না। শিল্প আর শিল্পীর এমন সমন্বয় ঘটাতে পারে ক’জন! ’।

জাতি তার এ যোগ্য সন্তানের অসীম অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ফেলোশীপ ও ১৯৯১ সালে তাকে মরণোত্তর ২১শে পদক প্রদান করা হয়। ১৯৮৩ সালে তিনি শিল্পকলা একাডেমিতে লালন সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শুধু এদেশেই নয়, দেশের সীমা অতিক্রম করে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

জীবদ্দশায় এমনকি মৃত্যুর পরেও সিদ্ধপুরুষ এ সাধকের সঙ্গলাভ ও বাউলতত্ত্ব অন্বেষণে বিভিন্ন সময়ে তার পর্ণকুটিরে ছুটে আসতেন বিদগ্ধ লোক গবেষকগণ। আমেরিকা, জাপান, নরওয়েসহ বিভিন্ন দেশের লোক সাহিত্য অনুরাগীরা অকৃষ্ট হয়েছেন মরমী এ সাধকের শিল্পকর্মে। যাদের মধ্যে বিশিষ্ট লালন গবেষক ড. ক্যারল সলম্যান, বিশিষ্ট লোক গবেষক মাথাউকি অনিচি, মিস ভেরী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া লোকসাহিত্য ওয়াল্ড হেরিটেজ’র অন্যতম প্রধান অংশ হিসেবে ঘোষণার পর থেকে বেড়ে গেছে খোদা বক্শ শাহ্’র বাস্তুভিটায় আন্তর্জাতিক অঙ্গণের মণিষিদের আনাগোনা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, মুখে মুখে মহান সাধকের স্মৃতি ও কর্মকে অম্লান রাখার প্রতিশ্রুতি শুধুুই প্রতিশ্রুতি রয়ে গেছে। এখনও তা কাজে পরিণত না হওয়ায় সমাধি নির্মাণ সম্পন্নসহ গুণী এ সাধকের স্বহস্তে লিখিত পা-ুলিপি, ব্যবহৃত নানা আসবাব সামগ্রীসহ যাবতীয় স্মৃতি আজ ধ্বংসোম্মুখ। এই মহান ব্যক্তিত্বের বাস্তুভিটাসহ অসমাপ্ত সমাধীক্ষেত্রের বেহাল ও করুণ অবস্থা দেখতে আন্তর্জাতিক বিশিষ্টজনেরা আসলে বড়ই লজ্জায় পড়তে হয়। এ লজ্জা এলাকাবাসীসহ সমগ্র দেশবাসীর। প্রকৃত গুণী ব্যক্তিকে সম্মান করতে না পারার কালিমা আমাদের আচ্ছন্ন করে। এই কালিমা মোচনের দাবি আজ উচ্চকিত হয়ে উঠেছে।