অপরাধী যত বড় হোক দায়মুক্তি পাবে না

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, স্বল্প সময়ে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার বিচার নিষ্পত্তি করায় দেশের আপামর জনগণের আস্থা বিচার বিভাগের প্রতি আরও বেড়েছে। তিনি বলেন, অপরাধী যতো বড় হোক না কেন, সে দায়মুক্তি পাবে না। চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলা, প্রভাবশালী আসামি র‍্যাবের কতিপয় কর্মকর্তা দায়মুক্তির মনোভাব থেকে লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, যা সমগ্র জাতিকে স্তম্ভিত করেছে। সুপ্রিমকোর্টের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপের ফলে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা হয়। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার এক বাণীতে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধান বিচারপতির বাণীর আগের দিন সোমবার সাত খুনের মামলার রায় ঘোষণা করেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালত। এতে র‍্যাবের সাবেক ১৬ কর্মকর্তা ও সদস্যসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং আরও ৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তদের মধ্যে র‍্যাবের ব্যাটালিয়ন অধিনায়কসহ তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থাকাকালে অপরাধে যুক্ত হন। পৌনে তিন বছর আগের ওই ঘটনায় করা মামলায় র‍্যাবের ওই তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার দেখানো হয় হাইকোর্টের নির্দেশে। দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি শপথ নেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি তিনি অবসরে যাবেন। গতকাল দেয়া বাণীতে প্রধান বিচারপতি বলেন, সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা, গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ অঙ্গ হিসেবে অবদান রেখে আসছে। সমাজের অসংগতি দূরীকরণে সংবাদপত্র এবং সমাজ বিনির্মাণে সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের ভূমিকা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। মানুষের তথ্য জানার অধিকার এবং গণমাধ্যমের তথ্য জানানোর গভীর দায়বদ্ধতার প্রশ্নে সামাজিক অঙ্গীকার নিয়ে সংবাদপত্র প্রতিনিয়ত অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন সাংবাদিকেরা। ফলে বিচার বিভাগ ও সাংবাদিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক অত্যাবশ্যক।

প্রধান বিচারপতি বলেন, রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য স্বতন্ত্র চাকরির বিধান রয়েছে। অধস্তন আদালতের বিচারকদের কাজের প্রকৃতি ও ধরন অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র। বিচারকদের শৃঙ্খলামূলক বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের পক্ষে স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিঘ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সংগত কারণে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা প্রণয়ন আবশ্যক বলে এর খসড়া প্রণীত হয়েছে। অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণসংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশের বিষয়ে সরকারের সাথে সামান্য বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও তা অচিরেই দূর হবে বলে আশা করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, বিচারকদের স্বতন্ত্র আচরণ ও শৃঙ্খলা বিধিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে।

প্রধান বিচারপতি বলেন, রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য নীতির প্রতিফলন হচ্ছে সংবিধানের মূল চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিচার বিভাগ এর সীমার বাইরে গিয়ে অন্য বিভাগের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। তিনি প্রত্যাশা করেন, রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগ বিচার বিভাগের দায়িত্ব পালনে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করবে না। প্রতিটি বিভাগকে দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে অপরিহার্যভাবে সৃষ্ট শীতল সম্পর্ককে ইতিবাচক দৃষ্টিতে গ্রহণ করলে প্রতিটি বিভাগের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রভূত কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মামলার জট—এ কথা উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্রচলিত আইনের অস্বচ্ছতা। ত্রুটিপূর্ণ ও সেকেলের আইনের ফলে মামলার সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। দেশের নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত মামলার ভারে জর্জরিত। বিগত দুই বছরে মামলা নিষ্পত্তি বৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক। গত দুই বছরে নিষ্পত্তির হার শতকরা প্রায় ১৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিচারকেরা আন্তরিকভাবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করায় বিগত বছরগুলোর তুলনায় মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আইনের নিরন্তর সংস্কার দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির জন্য অপরিহার্য। শত বছরের পুরোনো পাঁচটি আইন সেকেলে ও চারটি আইনে অনেক ত্রুটি রয়েছে। এই আইনগুলোর দুর্বলতার কারণে মামলার সংখ্যা অযথা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সঙ্গত কারণে এসব আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার অপরিহার্য। তিনি বলেন, আইনের খসড়া প্রণয়নের সাথে যারা জড়িত, তাদের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়, সে বিষয়ে বাস্তব জ্ঞান না থাকায় অনেক আইনে অসঙ্গতি থেকে যায়। ত্রুটিপূর্ণ আইনের ফলে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও বিচার বিলম্বিত হয়। সে কারণে আইন প্রণয়নের সময় বিচার বিভাগের সাথে পরামর্শ করা হলে বহু ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীভূত হবে বলে বিশ্বাস প্রধান বিচারপতির।

আট পৃষ্ঠার বাণীর শেষাংশে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গরিব-অসহায়, হতদরিদ্র বিচারপ্রার্থীসহ আপামর বিচারপ্রার্থী জনগণকে বিচারসেবা প্রদানে সর্বস্তরের বিচারকেরা আরও বেশি সংবেদনশীল ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ক্রমশ বাড়বে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এশিয়ার একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হবে। সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সরকার তথা সংশ্লিষ্ট সবার আরও বেশি সহযোগিতা কাম্য।