লালন ঘরনার প্রখ্যাত মরমী গীতিকবি ইউনুস আলী শাহ্’র ওফাত দিবস পালিত

 

রহমান মুকুল: লালন ঘরানার মরমি কবি, সাধক ও গীতিকারদের মধ্যে এক উজ্জ্বলতম নাম ইউনুস আলী শাহ্ ওরফে উদাস বাউল। গতকাল সোমবার ছিলো লালন ঘরনার প্রখ্যাত মরমী গীতিকবি ইউনুস আলী শাহ্’র ১৫তম ওফাত দিবস। এ উপলক্ষে মরহুমের মাজার প্রাঙ্গণ অর্থাৎ আলমডাঙ্গা উপজেলার নওদা পাঁচলিয়া গ্রামে ২ দিনব্যাপী সাধু সংঘের আয়োজন করা হয়েছে। ইউনুস আলী শাহ বাউল মহলে উদাস বাউল নামে পরিচিত। গত বেশ কয়েক বছর ধরে মাজার প্রাঙ্গণে ইউনুস আলী শাহ্’র জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী জমজমাট আনুষ্ঠানিকতায় পালিত হয়ে আসছে। লালন ঘরানার মরমী সাধকদের অন্যতম মরহুম ইউনুস আলী শাহ। তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত মরমী কবি ও সাধক খোদাবক্স শাহ’র সবচে’ উল্লেখযোগ্য শিষ্য ও জামাতা ছিলেন।

১৯৪৮ সালে আলমডাঙ্গা উপজেলার জামজামি ইউনিয়নের পাঁচলিয়া গ্রামের ফকিরপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন ইউনুস আলী শাহ। তিনি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও পরে এরশাদপুর একাডেমিতে লেখাপড়া করেন। প্রথম বিয়ে করেন কুষ্টিয়া চৌড়হাসের মেয়ে সুফিয়া বেগমকে। সে পক্ষের এক পুত্র সন্তানকে রেখে স্ত্রী মারা যান। সে মাতৃহারা ছেলেই বর্তমানে বাউল মহলে সানোয়ার দেওয়ান নামে পরিচিত। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর নিজ গুরু খোদাবক্স শাহ’র সুন্দরী ও বিদূষী কন্যা মালঞ্চ বেগমকে বিয়ে করেন। এ পক্ষে মখলেস উদ্দীন নামের আরেক পুত্র সন্তান রয়েছে।

শুধু মরমী সাধকই ছিলেন না তিনি। আধ্যাত্ম চেতনায় আত্মলীন হয়ে তিনি ৪৫০টি সঙ্গীত রচনা করেছেন। তিনি অনেক গীতি কবিতাও রচনা করেছেন। আধ্যত্ম চেতনায় সমৃদ্ধ তার সঙ্গীতগুলো বাউল মহলে দারুণ জনপ্রিয়। পরবর্তীকালে ইউসুফ শাহ, আইনুদ্দীন শাহ, রাজ্জাক পাগল, চাঁদ আলী শাহসহ অনেক শিষ্যই তার সঙ্গীতের সুরভি ছড়িয়ে বাউল মহলে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। মরমী দর্শন চেতনা তার সঙ্গীতের ছত্রে ছত্রে অধ্যাত্মবোধের আলো ছড়িয়েছে। যেমন- ‘কেবা ঘোরাই আলের উপর/ রাখি না খবর/ দুনিয়া মায়ার লাটিম ঘুরছে নিরন্তর॥ কেবা লাটিমের উপর বসে/ একটি সুতোই পাক দিতেছে/ জনম ভরে ঘুরতে আছে- নিলাম না খবর॥ লাটিমের আলে কেবা/ তারে আমি না করলাম সেবা/ আমার ভজন সাধন সবই বৃথা/ ভুলের বেগার জনম ভর॥ যে জন চালায় মায়ার লাটিম/ সে জনা তো বড়ই হাকিম/ আমি উদাস নাই কো তালিম/ কাম জ্বালাতে হই বিভোর॥’

তার সঙ্গীতে জন্মভূমি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি সংবেদনশীলতা সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। যেমন- ‘মাছ ধরবি কি কলে-বলে  উজালের খালে।/ সাত সকালে যেখানে মরলিরে হুচা ঠেলে।’ রোমান্টিকতাও তার সঙ্গীতকে অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছে। যেমন- ‘ও মোরগ বাগ দিসনে জোর করে/ হোগতা মোল্লা ওজু করতেছে।’ তাছাড়া গুরুর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা তার সঙ্গীতে সঙ্গীতে বিধৃত হয়েছে। যেমন- ‘বক্স বলে রায় চরণে/ বাঁনধো নিরিখ দুই নয়নে।/ উদাস রে তুই ভুলিস কেনে/ সই করেছিস দাসক্ষতে।’ খোদাবক্স শাহ’র শিষ্যদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচে’ কীর্তিমান পুরুষ। সঙ্গীতেও তার কন্ঠ ছিলো অনবদ্য ও আবেগমন্থিত।

ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ, নিষ্ঠাবান ও সৃজনশীল। মাত্র ৫৪ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। প্রকৃত অর্থেই ফকির ছিলেন তিনি। জীবনে কখনও ফিকিরি করেননি অথবা ভেগ সর্বস্ব ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। উত্তাল যৌবনে তিনি দেশমাতৃকার পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত করতে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর প্রায় সকলেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার দলে যোগ দিলেও তিনি দেননি। এমনকি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড অফিসেও তাকে ধর্না দিতে কোনো দিন দেখেনি কেউ।

অবধারিতভাবেই মনে হয় সমাজের দুস্টচক্র ভালো মানুষকেই কষ্ট দেয় বেশি। ভালো মানুষকেই অতলান্তিক বেদনামন্থন করে যাপন করতে হয় দুঃসহ জীবন। ইউনুস আলী শাহ্’র জীবনটাই এক ট্র্যাজিক আখ্যান। জাসদের এক নীতিভ্রষ্ট নেতা ‘৮০ দশকে ইউনুস আলী শাহ্’র প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। ওই ঘটনায় তিনি আর স্বাভাবিক থাকতে পারেননি। একাকীত্বের ভার, সমাজের শঠতা ও নৈরাশ্য তাকে অক্টোপাসের মতো গ্রাস করেছিলো। তিনি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। এমন বেদনাদায়ক পরিস্থিতির এক পর্যায়ে ২০০২ সালের ১৭ মাঘের রাতে এ অভিমানি সাধকপুরুষ সকলকে ফাঁকি দিয়ে ধরাধাম ত্যাগ করেন।