স্বপ্ন টপকে সাফল্যের শিখরে এমএ রাজ্জাক খান

 

স্টাফ রিপোর্টার: আলোকিত মানুষ প্রত্যাশী বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অন্যতম স্লোগান- মানুষ তার স্বপ্নের সমান। এ স্লোগানকেও টপকে দেশজুড়ে খ্যাতির শিখরে ওঠা নক্ষত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম এমএ রাজ্জাক খান। তিনি চুয়াডাঙ্গারই কৃতীসন্তান। দেশের গর্ব। বর্তমানে তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের মূল স্লোগান- আমার পণ্য, আমার দেশ- গড়বো বাংলাদেশ।

স্বপ্নকে পেছনে ফেলে সাফল্যের শিখরে পৌছে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের যোগানদাতা মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক লি. ও মাইওয়ান ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক খানের স্পষ্ট অভিমত ব্যবসা মানে শুধু বিনিয়োগ নয়, ব্যবসায় সফলতার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন সাহস। এরপরই ধৈর্য-সহ্য সততার সাথে অর্জিত জ্ঞানের যথাপোযুক্ত প্রয়োগে সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয় পৌঁছে দেবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।

শৈশবে জীবনের লক্ষ্য কি ইন্ডাস্ট্রিয়াল হওয়াই ছিলো? নাকি আরো কিছু? ঢাকা বনানীর প্রশস্ত প্রধান সড়কের ধারে বড় এক ভবনে প্রতিষ্ঠানটির বিশাল আয়তনে সাজানো গোছানো প্রধান কার্যালয়। এ কার্যালয়ে বসেই আপ্যায়ন পর্বে পায়েশের চামচে চুমুকের ফাঁকে আলাপচারিতায় উঠে আসে এসব প্রশ্ন। এমএ রাজ্জাক খানও বিচক্ষণ। গল্পের ছলে তুলে ধরেন তার আদ্যপান্ত। বলেন, আজকের অবস্থানে যে এতো দ্রুত পৌঁছে যাবো তা সত্যিই ছেলেবেলায় ভাবিনি। ভালো একটা ব্যবসা। বাড়ি আর গাড়ি থাকলেই তো চলে। এরকমই ভাবতাম। সেই ভাবনা থেকেই প্রথম সিঙ্গাপুর প্রবাসে কর্মজীবন শুরু। সেখানে কাজ করেছি আর বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পড়েছি। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিঙে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করে অর্জিত অর্থ নিয়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৯৯ এর জুনে দেশে ফিরি। বড়ভাই আব্দুল হাকিম খানের সাথে চুয়াডাঙ্গাতে শোরুম দিয়ে শুরু করি ব্যবসা। এর কিছুদিন পরই ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রি করার পরিকল্পনা মাথায় আসে। ২০০২ সালের ১ জুন ঢাকার মোহাম্মদপুরে খান মার্কেটিং নামে শুরু হয় যাত্রা। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে ব্যবসা। বড়ভাই আব্দুল হাকিম খানকে সাথে নিয়ে মাইওয়ানের যাত্রা শুরু ২০০৪ সালে। ২০১২ সাল পর্যন্ত যৌথ ব্যবসা পরিচালনা। ২০১৩ সালে মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক লি. নামে যাত্রা শুরু। এসব যেন সত্যিই চোখের পলকে পাল্টে যাওয়া। স্বপ্নকে টপকানো তো বটেই।

যাত্রা শুরু করলেই কি পাওয়া যায় মসৃণ পথ? এমএ রাজ্জাক খানের সাফ জবাব। না। নিজের পথ নিজেকেই গড়ে নিতে হয়। গড়ে নেয়ার মতো দক্ষতা অর্জনের বিকল্প নেই। কেননা, সর্বক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা। যেমন আমার ক্ষেত্রেও পদে পদে পরিলক্ষিত হয়েছে বহু বাধা বিপত্তি। শুরুতে যখন খুচরা যন্ত্রাংশ, পিকচার টিউব, কেবিনেট, পিসিবিসহ প্রয়োজনীয় সরাঞ্জামাদি দিয়ে অনেকটা ঘরোয়া কারখানায় তৈরি করি শাদাকালো টেলিভিশন। তখন তা বিক্রি অতোটা সহজ ছিলো না। নিজে পায়ে হেঁটে রাজধানীর স্টেডিয়াম মার্কেট ও গুলিস্তান পাতাল মার্কেটে মার্কেটিং করতে থাকি। স্টেডিয়াম মার্কেটে তেমন সাড়া না পেলেও গুলিস্তান পাতাল মার্কেটের এক ব্যবসায়ীর সহযোগিতা ও উৎসাহ আমাকে সামনের দিকে যেতে সহায়তা করেন। পথে হেঁটেছি বলেই তো ওই ব্যবসায়ীর সহযোগিতা পেয়েছিলাম। অবশ্য সততার কারণে সব সময়ই সরকারের সহযোগিতা আমার পাথেয়।

২০০৩ সালে প্রথমে ঢাকার নওয়াবপুরে একটি শোরুম নেন। চায়না ও ইন্ডিয়া থেকে আমদানি শুরু করেন। সাদাকালোর সাথে রঙিন টিভি উৎপাদন। মোহাম্মদপুরের ফ্যাক্টরি পরিবর্তন করে হাজি ওসমান গনী রোডে নেয়া হয়। ২০০৫ সালে মাইওয়ান ব্র্যান্ড নিয়ে রঙিন টিভি ও রেফ্রিজারেটর অ্যাসেম্বিলিং শুরু। হাটখোলা রোড ২০০৬ সালে ফ্রিজসহ সব ধরনের ইলেকট্রনিক্স পণ্য অ্যাসেম্বিলিং কাজে হাত দেয় কোম্পানি। ২০০৯ সালে গাজীপুরে মাইওয়ান ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লি. স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ওই কাখানায় প্রতিদিন ২০০ ফ্রিজ, ৫০ এসি, ৫০০ সিআরটি টিভি উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে এবং উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। ২০১৩ সাল থেকে ওই কারখানায় পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয়। গত বছর থেকে এখানে রেফ্রিজারেটর, এসি, এলইডি অ্যাসেম্বিলিং ও উৎপাদন শুরু হয়। উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে বলে মাইওয়ান ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজের স্বপ্নপুরুষ এমএ রাজ্জাক খান জানিয়েছেন। ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে এবং আরও একটি কোম্পানি মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক লি. দ্রুত সময়ে সফলতা অর্জন করে। এ কোম্পানির ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে- মাইওয়ান, মিনিস্টার ও মাইলাইফ। তিনি জানান, আমাদের কারখানায় বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানের ফ্রিজ, এসি ও এলইডি টেলিভিশন উৎপাদন করা হচ্ছে। যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

শুধু কি ব্যবসা? না। সামাজিক কর্মকাণ্ডে রয়েছে রাজ্জাক খানের অনন্য অবদান। তিনি রোটারি ক্লাব ঢাকা (ইস্ট) এর ফার্স্ট ক্লাস প্রেসিডেন্ট। ক্রেতা ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ ফাউন্ডেশনের মহাসচিব। এছাড়াও মসজিদ মাদরাসাসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান নির্মান ও রক্ষণাবেক্ষণে সব সময়ই তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। আমার পণ্য, আমার দেশ গড়বো বাংলাদেশ স্লোগান লালন করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দেশ গড়ার প্রত্যয়ে স্রোতে গা না ভাসিয়ে স্রোতের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে বাংলার মানুষের হাতে সুলভ মূল্যে গুনগত মানসম্মান ইলেকট্রনিক্স পণ্য পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটির মূল কর্তার পারিবারিক পরিচিতি? সেটাও বেশ গর্বের। এমএ রাজ্জাক খানের স্ত্রী দিলরুবা তনু। তিনি এসএসসি ও এইচএসসিতে স্টার মার্কস, বি.ফার্ম ও এম.ফার্মে প্রথম শ্রেণি অর্জন করেন। তিনি বর্তমানে মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এমএ রাজ্জাক খানের দু ছেলে। আল-আকসা তানজিম খান ও রাইয়ান তানদিদ খান বর্তমানে অধ্যায়নরত।

সিঙ্গাপুর পাড়ি দেয়ার অর্থের জোগান দাতা কে? এমএ রাজ্জাক খান বললেন, অনেকগুলো ভাই-বোন আমরা। চুয়াডাঙ্গা পলাশপাড়ায় ১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করি। চুয়াডাঙ্গায় উচ্চ মাধ্যমিক পড়া শেষে সিঙ্গাপুরে যখন যাই, তখন আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়। এ টাকা পিতা হাজি আফজাল খান, বড় ভাই গোলাম মোস্তফা খান ও বড় বোন দেন। সেখানে গিয়ে কাজ করেছি। পড়েছি। সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পরও চালিয়ে গেছি লেখাপড়া। দেশে ফিরে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স এবং একই বিষয়ে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করি।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা? গাজীপুরের ধীরাশ্রমে মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক লি. ও মাইওয়ান ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৫ একর জমির ওপর গড়ে ওঠেছে। ত্রিশাল ও ময়মনসিংহে ৫০ একর জমির ওপর ইলেকট্রনিক্স পার্কের ২য় প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মাধ্যমে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের যেমন ব্যবস্থা হচ্ছে তেমনই দেশে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের চাহিদা মেটাতে পারছি। এক সময় এতো কিছু করতে পারবো তা ভাবিনি। একটার পর একটা করতে পেরে সত্যিই আত্মবিশ্বাসটা বেশ মজবুত হয়েছে। আমার বিশ্বাস আমি মানুষের জন্য, দেশের জন্য আরো কিছু করতে পারবো। কেননা, আমি বিশ্বাস করি- মানুষের জন্য ইন্ডাস্ট্রিজ, ইন্ডাস্ট্রির জন্য মানুষ নয়।