এ লগন শুধুই ভালোবাসার…

 

স্টাফ রিপোর্টার: আজ ভালোবাসা দিবস। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে। দুরু দুরু বুক, চোখে মেখে মায়ার কাজল, ভালোবাসা প্রকাশের মাহেন্দ্র দিন আজ। রৌদ্রোজ্জ্বল শুভ্র সকাল, সোনালি দুপুর, ঝিরিঝিরি দখিনা হাওয়ার শান্ত বিকেল, জোছনায় ঝলমল রূপালী রাত-এর লগনগুলো শুধুই ভালোবাসার। ’হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে/মন বাড়িয়ে ছুঁই ’-এর মতো মনে মন রেখে হূদয়ের উষ্ণতা অনুধাবন করার দিন। ভালোবাসা কি? এই প্রশ্নে খেই হারিয়েছেন সবাই। কেউ বলেছেন, প্রেমের আনন্দ থাকে শুধু স্বল্পক্ষণ, প্রেমের বিরহ থাকে সমস্ত জীবন। আবার কেউ, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানী।’ অথবা ‘আমি ভালোবাসি যারে, সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে। কবিগুরুর ভাষায়, তোমরা যে বলো দিবস রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’-সখী ভালোবাসা কারে কয় ! সে কি কেবলই যাতনাময়। সে কি কেবলই চোখের জল? ভালোবাসার কথা প্রকাশের জন্য সুদৃশ্য মলাটে মোড়া বইয়ের আটপৌরে দিন ফুরিয়েছে। আঙুল কেটে রক্তে রক্ত মিলিয়ে দেয়া, চিঠির ভাঁজে গোলাপের পাপড়ি গুঁজে দেয়া, দিস্তায় দিস্তায় কাগজ নষ্ট করে কাব্য চর্চা, চন্ন্ডিদাস অথবা দেবদাসের মত চরিত্র হয়ে ওঠার-অনুষঙ্গগুলো এখন একেবারে ম্রিয়মাণ। তবে ভালোবাসা সেই আগের মতই আছে। যান্ত্রিকতা তাকে শুধু বহুমাত্রিক করেছে। এখন নীল খামে ভরা চিঠির দিন হরণ করেছে ইন্টারনেট রাজ্য। ভার্চুয়াল স্পর্শে এখন সাত সাগর তেরো নদীর ওপারে থাকা প্রিয়জন কাছে এসেছে। কাগজ-কলম-দোয়াতের দরকার হয়না। পলক ফেলার আগেই ফেসবুকের ওয়াল, ইনবক্স, মেসেঞ্জার, টুইট ভরে উঠছে হৃদয়ের কথকতায়। সেলফিতে ভরে উঠছে সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যম। মুঠোফোন, ফেসবুক মেসেঞ্জার, হোয়াটসএ্যাপ, ইমো, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম-এ ক্ষুদে বার্তা অথবা চ্যাটিং-এ এখন পুঞ্জ পুঞ্জ প্রেমকথার কিশলয় পল্ল­বিত হয়ে উঠছে। গতকাল ছিলো বাঙালির বসন্ত বরণের দিন। একদিকে ঋতুরাজ বসন্তের আগমন অপরদিকে আজ এসেছে ভালোবাসা দিবসের ছোঁয়া। পশ্চিমা দুনিয়ার ফোরটিন্থ ফেব্রুয়ারির এই প্রেম উত্সব তারুণ্যের ভেতর এক অদেখা ভূবনের উত্তেজনা ছড়ায়। প্রিয়জনকে উপহার দেয়ার ধুম পড়ে যায়।

অনেক দিবসের ভিড়ে ভালোবাসা দিবস সম্পূর্ণ আলাদা মাত্রায় উত্কীর্ণ। এর সাথে প্রেম আর অনুরাগের অমনিবাস। লোক কবি জিওফ্রে চসার ক্যান্টারবারি টেলস লেখার আগে ভ্যালেন্টাইনের গোটা ব্যাপারটাই ছিলো রোমান, ক্রিশ্চান, যুদ্ধ ইত্যাদির গল্প। প্রেমের ছিটেফোঁটাও সেখানে ছিলো না। চসার লেখেন, ভ্যালেন্টাইন দিবসে পাখিরা সঙ্গী খুঁজে নেয়। অতঃপর কপোত-কপোতীরা ১৪ ফেব্রুয়ারি ধরে ঝুলে পড়লো। আমেরিকানরা গল্পটাকে আর একটু জমানোর জন্যে জুড়ে দিয়েছে যে, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগের রাতে ভ্যালেন্টাইন জেল সুপারের অন্ধ মেয়েকে ভ্যালেন্টাইন কার্ড দিয়েছিলেন, তাতে লেখা ছিলো, ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন। পরবর্তীতে গবেষকরা দেখেছেন, ভ্যালেন্টাইনের গল্পটি প্রেম সংক্রান্ত ছিলো না। এর কোনো সত্যতাও মেলেনি। তাতে কি? প্রেম-ভালোবাসা দিবস পালনের একটা মওকা বের করে নিয়েছে প্রেমিক-প্রেমিকারা। আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো বহুমাত্রিক বর্ণময় প্রচারণায় এই দিনটিকে ভালোবাসা দিবস বলে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। দিনটিকে উপজীব্য করে তারা তৈরি করে ফেলেছে বিশাল এক বাজার। লাখ লাখ কার্ড, ঘড়ি, হিরা বিক্রি হচ্ছে, মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডাররা এসএমএস থেকে টাকা তুলছে, টিভি চ্যানেলগুলোও ফলাও করে ভালবাসার মহিমা প্রচার করছে। দেশে যেন ভালবাসার উত্সব বসেছে।

ভালবাসা দিবসের উত্পত্তি সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন, দিবসটির সুচনা প্রাচীন দুটি রোমান প্রথা থেকে । এক পাদ্রি ও চিকিত্সক ফাদার সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে দিনটির নামকরণ হয়েছে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’। প্রধান যে কাহিনীটি প্রচলিত আছে তা হলো:২৬৯ খৃষ্টাব্দে ইটালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেইটাইন’স নামে একজন খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিত্সক ছিলেন। ধর্ম প্রচারের অভিযোগে তত্কালীন রোমান সম্রাট তাঁকে বন্দী করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার ছিলো নিষিদ্ধ। বন্দী অবস্থায় ওই পাদ্রী জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিত্সায় সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেইটাইন রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিন ছিলো ১৪ ফেব্রুয়ারি। অতঃপর ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস পাদ্রী ভ্যালেইটাইনস-এর স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস ঘোষণা করেন। ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেইটাইন উত্সব নিষিদ্ধ হয়। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময এ দিবস উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবস প্রত্যাখ্যাত হয়। তবে বর্তমানে পাশ্চাত্যে এ উত্সব মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। আর আমাদের দেশে এদিনটিতে কেবল প্রেম বিনিময় নয়, তরুণ-তরুণীদের মাঝে গোপনে বিয়ের হিড়িক পড়ে যায় বলেও শোনা যায়।