আদালতে তিন শিশুর কান্না : মায়ের হেফাজতে দিলে আমরা আত্মহত্যা করবো

কুষ্টিয়ায় পারিবারিক নানা অশান্তির কারণে ১৩ বছরের দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদ

 

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: ‘মায়ের হেফাজতে দিলে আমরা আত্মহত্যা করবো। মা খারাপ, সে কোনো দিনই আমাদেরকে সন্তানের পরিচয়ে মানুষ করতে পারবে না। আমাদের ৩ ভাই-বোনকে কোনো দিনই সে আপন করে নিতে পারবে না।’ গত মঙ্গলবার দুপুরে কুষ্টিয়ার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এজলাসের সামনে দাঁড়িয়ে এ ভাবেই বার বছরের শিশু সোহা আদালতের রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আকুতি জানান।

শিশু সোহা বলে- আমাদের মায়ের হেফাজতে দিলে আমরা আত্মহত্যা করবো। আইনের কাছে যেন মানবিক বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। সন্তানদের এমন আহাজারিতে বিকেলে পুনরায় আদালত বসানো হয়। আদালত দীর্ঘ সময় মা-বাবা আর সন্তানদের উপস্থিতিতে আরেক দফা রায় ঘোষণা করেন। বাদী-বিবাদীর সম্মতিতে রায়ে ২ বছর ৭ মাসের সন্তান ফারাবীকে তার মায়ের হেফাজতে দিয়ে বাকি ২ সন্তান ১২ বছরের সোহা আর ৭ বছরের তাহশীদকে বাবার হেফাজতে থাকার আদেশ দেন।

তবে এই আদেশেও খুশি হতে পারেননি ৩ সন্তান। রায় শোনার পর ৩ শিশু আদালত কক্ষেই পুনরায় কান্নায় ভেঙে পড়ে। এ সময় সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। আদালতের বিচারক এবং অন্যান্য কর্মচারীরাও আবেগ আপ্লুত হয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে মা ছোট সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন আর অন্য ২ সন্তান তাদের পিতার সাথে বাড়িতে ফিরে যায়। গত মঙ্গলবার বিকেলে এই হৃদয় বিদারক ঘটনাটি ঘটে কুষ্টিয়া কাক্টেরেট কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।

জানা যায়, ২০০৩ সালের ৪ মে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ভাদালিয়া গ্রামের তৌহিদুল ইসলাম তারিকের সাথে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার থানাপাড়া এলাকার সানজিদার বিয়ে হয়।

সানজিদার অভিযোগ, বিয়ের পর থেকেই স্বামী তারিকের পরিবারের লোকজনের অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। পারিবারিক নানা অশান্তির কারণে দীর্ঘ ১৩ বছরের দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদ ঘটে ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট। এর আগে স্ত্রী সানজিদা ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর শ্বশুর বাড়ির কাউকে না জানিয়ে সন্তানদের রেখেইে বাবার বাড়ি চলে যান। তাদের ঘরের ৩ সন্তান নিয়ে তারিক নিজ বাড়িতে বসবাস করে আসছিলেন। আর স্ত্রী সানজিদা বাবার বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। সামাজিকভাবে তাদের দাম্পত্যের কলহ মেটানোর বহু চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

এদিকে স্ত্রী সানজিদা গত বছরের ১৬ মার্চ নারী নির্যাতন আইনে কুষ্টিয়ার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এরই মাঝে সানজিদা নাবালক সন্তানদের নিজ হেফাজতে ফিরে পেতে আদালতে আরও একটি আবেদন জানান। মঙ্গলবার দুপুরে শুনানী শেষে কুষ্টিয়ার নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সীমা শারমিন ৩ সন্তানকে বাবার হেফাজত থেকে মায়ের হেফাজতে দিতে নির্দেশ দেন। বিচারকের এমন আদেশের পর ৩ শিশুর কান্নায় আদালতের পরিবেশ মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে যায়। তাদের কান্না আর আহাজারিতে পুরো আদালত এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। শিশুদের আর্তনাদ আর কান্নায় আদালতে উপস্থিত সকলের চোখে পানি চলে আসে। আদেশের পর পুলিশ শিশুদের মায়ের হেফাজতে দিতে গেলে তারা ৩ ভাই-বোনসহ পিতাকে জড়িয়ে আদালতের চেয়ার আকড়িয়ে ধরে বসে পড়ে। এ সময় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরাও যেন নির্বাক হয়ে পড়েন। বড় সন্তান আদিবা আনজুম সোহা চিৎকার দিয়ে তাদের পিতার নিকট ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আদালতের নিকট আবেদন জানায়।

এ সময় সোহা এবং অন্য ভাই আবুজর গীফারী তাওশী বলে, আমরা শিশু, আমাদের পিতা আমাদের লালন পালন করেছেন। মাকে আমরা চিনি না। আমাদের জোর করে মায়ের কাছে দিতে গেলে আত্মহত্যা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকবে না। এই বলে তারা আদালতে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সন্তানদের পিতা তারিকুলও বেঞ্চে বসে সন্তানদের জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। এই পরিবেশে বিকেলে দু পক্ষের উপস্থিতিতে পুনরায় আদালত বসানো হয়। আদালতের বিচারক পৃথক পৃথকভাবে সন্তান এবং পিতা ও মাতার বক্তব্য শোনেন।  দীর্ঘসময় উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে এবং উভয় পক্ষের সম্মতিতে ছোট ছেলে ওয়াসি হাসান ফারাবীকে মায়ের নিকট এবং অন্য দুই সন্তানকে পিতার হেফাজতে দেয়ার নির্দেশ দেন আদালতের বিচারক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সীমা শারমীন।

আদালতের এ রায়েও সন্তোষ হতে পারেননি সন্তানেরা। রায় শুনে সন্তানেরা আবারো হাউমাউ করে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে। তখন পুলিশ বিশেষ ব্যবস্থায় উভয় পক্ষকে আদালত থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলে কাঁদতে কাঁদতেই সকলেই আদালত ত্যাগ করে। এ সময় আদালতের বাইরে উভয় পক্ষের মহিলাদের হাতাহাতি করতে দেখা গেছে।

জানা যায়, ছোট ছেলে ফারাবী জন্মের পর থেকেই ফুফুর লালন পালনে বড় হয়ে ওঠে। ফারাবী জন্মের পর থেকে গর্ভধারীনি মাকে চেনে না। ফুফুকেই মা বলে ডাকে।

ফারাবীর মা (ফুফু) জানান- আমার কোনো সন্তান না থাকায় জন্মের পর থেকেই আমি ফারাবীকে দত্তক নিয়ে নিজের সন্তান হিসেবে লালন পালন করি। ফারাবী আমাকে মা এবং আমার স্বামীকে বাবা বলেই ডাকে। আমরা স্বামী-স্ত্রী পিতা-মাতার স্নেহ দিয়েই তাকে এই আড়াই বছর পালন করেছি।