আজো অবহেলিত ভাষা সৈনিক খলিলুর রহমান

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: ভাষা সৈনিকদের খোঁজ আর কেউ রাখে না। ভাষার মাস এলেই খোঁজ পড়ে ভাষা সৈনিকদের। সে রকমই নির্ভতচারী এক ভাষা সৈনিকের নাম খলিলুর রহমান (৮৫)। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’র আন্দোলনের ছাত্রনেতা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার পৌর সদরের বাসিন্দা খলিলুর রহমান। বয়সের ভারে এখন ক্লান্ত তিনি। অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। ক্লান্ত শরীরে কোনমতে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলাচল করছেন তিনি। জীবন যুদ্ধের প্রায় শেষ প্রান্তে এসেও ভাষা সৈনিকের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি তিনি। ১৯৫১ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলনের মিছিল মিটিং এ অংশগ্রহণ করেন। তৎকালীন সময়ে তিনি জগন্নাথ কলেজের একটি ইউনিটের ছাত্রনেতা হিসেবে মিছিল মিটিং এর নেতৃত্ব দিতেন।
ভাষা সৈনিক খলিলুর রহমান জানান, বাঙ্গালীর দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম আমি। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের মায়ের মুখের ভাষা বাংলা কেড়ে নিতে চেয়েছিলো। তারা জোর করে আমাদের ওপর তাদের উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলো। স্বদেশ প্রেম ও মার্তৃভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। তিনি আরো জানান, ২৭ জানুয়ারিkushtia-vasa-soinik-pic-1 ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেছি আমি। ভাষা আন্দোলনের সময় আমি ইন্টার মিডিয়েটের ছাত্র। তৎকালীন ঢাকা জগন্নাথ কলেজে ব্যবসায় শাখার দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র ছিলাম। জগন্নাথ কলেজের একটি ইউনিটের ছাত্রনেতা হিসেবে মিছিল মিটিং এর নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই বন্ধুদের সাথে ও সহযোগীদের নিয়ে এই ভাষা আন্দোলনে করেছিলাম। ভাষা আন্দোলন চলাকালে আমরা সবাই ঢাকাতেই ছিলাম। ঢাকা থেকেই আমরা কয়েকজন নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। তখন আমি ১০/ই আজিমপুর কলোনিতে থাকতাম। সেখান থেকেই মূলত আমি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। মিছিলে গুলিবর্ষণের পরে কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তারপর আমি বাড়িতে চলে আসি।
তিনি আরো জানান, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কার্জন হল থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশ যখন বৃষ্টির মতো গুলি চালাচ্ছিলো। সে সময় আমি ছিলাম মিছিলের অগ্রভাগে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এই স্লোগান দিতে দিতে মিছিল নিয়ে আমরা সামনের দিকে এগোতে থাকি। এক পর্যায়ে কোনো কারণ ছাড়ায় অযৌক্তিক ভাবে পুলিশ আমাদের ্ওপরে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। আমার সাথে থাকা সামনের কয়েকজনের পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়লে আমি অন্যান্য ছাত্রদের সাথে পুলিশের তাড়া খেয়ে নিরাপদ স্থানে আত্মগোপন করি। ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যাই আমি। তারপর ২২ ফেব্রুয়ারি মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে শহীদদের রূহের মাগফেরাত কামনায় গায়েবানা জানাজায় অংশগ্রহণ করি। তারপর ঢাকা ছেড়ে বাড়িতে চলে আসি।
তিনি আরো জানান, উর্দুকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারপর থেকেই আমরা হোস্টেলে এর প্রতিবাদ করার চিন্তা করি। একপর্যায়ে আমরা এর প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা প্রায় ১ মাস ধরে এই আন্দোলন করার পরিকল্পনা করি। এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা মিছিল বের করি। সেদিন আমরা আমাদের কয়েকজন সহযোগীকে হারায়। এতে আন্দোলন আরো জোরদার হয়। তিনি জানান, ভয়াবহ সেই দিনের কথা আজও আমার মনে পড়ে। ভুলে যাওয়ার চেষ্টার করেও আমি ভুলতে পারিনা। চোখের সামনে বন্ধুদের মরতে দেখেছি। যাদের সাথে চলেছি তাদের হারানোর সেই দিনের ঘটনা আমি কোন ভাবেই ভুলতে পারিনা। সেই স্মৃতিগুলো আমাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ায়। আর অনেক ঘটনা রয়েছে তখনকার সময়ের, কিন্তু বয়স হয়েছে তো এখন আর সঠিক সবকিছু মনে করতে পারি না।
তিনি আরো জানান, আমি একজন ভাষা সৈনিক হিসাবে এখন পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়নি। আমি ভাষা আন্দোলনের পর থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত অবহেলিত ছিলাম। আর আমি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়ার জন্য কোনো যোগাযোগ করিনি। তখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে পেরেই নিজেকে স্বার্থক বলে মনে করেছিলাম। এজন্য রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার আশা করিনি। এজন্য এখন পর্যন্ত আমি একজন ভাষা সৈনিক হওয়া সত্বেও কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। তবে মরার  আগে একজন ভাষা সৈনিক হিসাবে রাষ্ট্রীয় সম্মান পেতে মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় আমার।
কর্মজীবনে খলিলুর রহমান প্রথমে চ-িপুর প্রাথমিক বিদ্যায়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করি। পরে সেখান থেকে ভেড়ামারা বোর্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে ১৯৯১ সালের ২৬ জানুয়ারি অবসর গ্রহণ করি। খলিলুর রহমানের পিতা মরহুম বাবর আলী ছিলেন একজন হোমিও ডাক্তার। আট বোন এবং পাঁচ ভাই। তিনি ছিলেন সবার বড়। বর্তমানে তারা চার ভাই এবং ছয় বোন রয়েছে ১৯৭২ সালে আমার স্ত্রী হামিদা খানম বেলা তিন মেয়ে ও এক ছেলে রেখে মৃত্যুবরণ করেন। এখন পরিবার বলতে তার একমাত্র ছেলে তার নাতি-নাতনিরা।
বর্তমানে তার জীর্ণ কুঠিরে নাতি-নাতিদের সাথে পুরোনো দিনের স্মৃতির কথা বলে বলেই সময় কাটান এই ভাষা সৈনিক। সময়ের সেই সহগামী, সতীর্থদের নাম স্মরণে আনতে না পারলেও আমার স্মৃতিপটে ভাঁসে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীর সেই দিনটির কথা। বর্তমানে ৫২’র ভাষা সৈনিক খলিলুর রহমানের ছেলে-মেয়েদের দাবি যাতে তার বাবাকে শুধু ভাষা সৈনিকের সম্মান দেয়া হয়।