পরিবহন ধর্মঘটে দেশ অচল :সীমাহীন দুর্ভোগ

 

গাবতলীতে পুলিশ বক্স র‌্যাকারে আগুনমারমুখী পরিবহন শ্রমিকরা

স্টাফ রিপোর্টার: সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনায় বাসচালক জমির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার প্রতিবাদে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘট চলছিল। এরই মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সারাদেশ জুড়ে পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এই ধর্মঘটকে অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন।এদিকে চুয়াডাঙ্গায় পরিবহন শ্রমিক ধর্মঘটের আজ ৮দিন। খুলনা বিভাগের ১০ জেলার ৪দিন। আর সারা দেশের দ্বিতীয় দিন।  পরিবহন শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। রেলযোগাযোগের ক্ষেত্রে চরম অনিয়ম, স্বেচ্ছারিতা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে গতকাল দিনে ও রাতে যাত্রী সাধারণের শুধু ভিড়ই ছিলো না। অনিয়মের শিকার হয়ে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ট্রেনে উঠতে না পেরে কেউ কেউ ফুসে ওঠেন।  

     হঠাত করে ধর্মঘট শুরু হওয়ার ফলে রাজধানীসহ সারাদেশে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। বন্ধ রয়েছে পণ্যবাহী যানচলাচলও। যশোরের বেনাপোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামমসজিদসহ দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দরে আটকে আছে পণ্যবাহী কয়েক হাজার ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান। এতে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে ট্রেন স্টেশনগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। সকালে রাজধানীর একাধিক রুটে দু’একটি বাস চললেও দুপুরের পর থেকে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালসহ অন্যান্য আন্ত:জেলা বাসস্ট্যান্ড থেকে থেকে যাত্রীবাহী বাস ছেড়ে যেতে বাধা দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। আর পরিবহন ধর্মঘটের কারণে মাইক্রোবাস ও টেক্সিচালকরাও ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। রাতে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালে বিক্ষুদ্ধ পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় শ্রমিকরা পুলিশের একটি র্যাকার ও পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহিম বক্স দুদু চলমান পরিবহন ধর্মঘট প্রসঙ্গে বলেছেন, এটা আমাদের সাংগঠনিক কোনও সিদ্ধান্ত নয়। চালকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গাড়ি চালানো বন্ধ করেছেন। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় প্রচলিত আইনে বিচার করা হয়নি। বিশেষভাবে এর বিচার করা হয়েছে। আমরা চাই প্রচলিত আইনেই এ দুর্ঘটনার বিচার করা হোক। এ শ্রমিক নেতা বলেন, চালক জমিরকে সাজা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার গাড়ি চালনার বয়স ৩৩ বছর। এরপরও তাকে অদক্ষ চালক বলা হচ্ছে। তাহলে যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্সের বয়স দুই তিন বছর তারা গাড়ি চালাতেই জানেন না। আমরা আর গাড়ি চালিয়ে কী করবো। তাই আমরা গাড়ি চালানো থেকে অবসরে গেলাম। ধর্মঘট কীভাবে হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আদালতের রায়ের বিষয়ে আমরা সেদিন রাতেই আলোচনা করছিলাম। তখন রাতে টিভিতে খবর দেখলাম সাভারে সড়ক দুর্ঘটনায় মির হোসেন মিরু নামের এক চালকের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। মূলত এ রায়ের খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দেয়।

পূর্ব ঘোষণা ছাড়া কেন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে -এমন প্রশ্নের জবাবে শ্রমিক সংগঠনগুলোর খুলনা অঞ্চলের নেতারা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী এক চালকের সাজার প্রতিবাদে খুলনা বিভাগে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট চলছিল। এ অবস্থার মধ্যে সোমবার ঢাকার সাভারে ট্রাক চাপায় এক নারী নিহত হওয়ার ঘটনায় ট্রাক চালককে মৃত্যুদন্ড দেয় আদালত। এ অবস্থায় শ্রমিকরা আরো বেশি আতংকিত হয়ে পড়ে। তারা স্বতস্ফুর্তভাবেই নিজেরাই গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিয়েছে। তারা বলেন, আমরা আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে গাড়ি চালাতে গেলে দুর্ঘটনা কম বেশি হবে। কিন্তু দুর্ঘটনার জন্য মৃত্যুদণ্ড ও যাজ্জীবন সাজার রায় হওয়ায় আমরা রীতিমতো আতঙ্কিত। তারা বলেন, আমরা ধর্মঘট, কর্মবিরতি পালন করছি। এই কর্মবিরতি পূর্বনির্ধারিত কোনো কর্মসূচি নয় বলে দাবি করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা জেলা বাস মিনিবাস সড়ক পরিবহন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল হক সদু। তার ভাষ্য, শ্রমিকরা অন্য যানবাহন চলাচলে কোনো বাধা দিচ্ছে না।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের খুলনা বিভাগীয় কমিটির দফতর সম্পাদক শেখ শফিকুল ইসলাম মঞ্জু জানান, বিভাগীয় কমিশনারের অনুরোধে শুধুমাত্র খুলনা জেলায় ধর্মঘট কিছুটা শিথিল করা হয়। বাকি ৯ জেলায় ধর্মঘট চলমান ছিল। তিনি বলেন, ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়ে আলোচনা করার সময় সোমবার রাতে খবর আসে ঢাকার একটি আদালত সাভারে সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত মামলায় একজন চালককে মৃত্যুদন্ডের রায় দিয়েছে। এই খবর পাওয়ার পর সে বৈঠকেই ধর্মঘট দেশব্যাপী করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যহ বলেন, এক বাস চালকের যাবজ্জীবন সাজার রায় আসার পর শ্রমিকরা বিক্ষুব্দ হয়েছিলেন। কয়েকদিন ধর্মঘট পালনের পর সোমবার রাতে আমরা আলোচনায় বসে সমস্যা প্রায় সমাধান করে ফেলেছিলাম। পরে শোনা গেলো সাভারের একটি দুর্ঘটনায় এক ট্রাক চালকের ফাঁসির রায় হয়েছে। তিনি বলেন, বিক্ষুব্দ শ্রমিকরা এখন এখন অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে গেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আবার আলোচনায় বসবো। এস আলম পরিবহনের ঢাকা অঞ্চলের ইনচার্জ মোহাম্মদ মঞ্জুর মোরশেদ বলেন, পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘট ডেকেছেন, সারাদেশেই যান চলাচল বন্ধ। আমরা অসহায়ের মতো এর সঙ্গে আছি। পক্ষেও নাই বিপক্ষেও নাই। তিনি আরো বলেন, এর আগে কখনও চালকের এমন সাজা হয়নি। সে কারণে শ্রমিকরা ক্ষিপ্ত। আলোচনার মাধ্যমে এই অচলাবস্থার একটা সমাধান জরুরি। কুড়িগ্রাম-চট্টগ্রাম রুটের সৌখিন পরিবহনের চালক মাসুদুর রহমান হিরণ বলেন, গত বিশ বছর ধরে গাড়ি চালাই। রাস্তায় যদি একটা সাপও পড়ে, তারপরও আমরা সেটাকে বাঁচাতে চাই। কিন্তু এভাবে সাজা দিলে আমরা গাড়ি চালাতে পারব না। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতি সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান ও বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ড্রাইর্ভাস ইউনিয়নের সভাপতি তালুকদার মোঃ মনির বলেন, আমরা ধর্মঘট ডাকিনি। ডেকেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। তবে শ্রমিকের সাজা নিয়ে এ ধর্মঘট। সে কারণে আমরা শ্রমিকদের দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছি।

যশোর অফিস জানায়, বাস চালক জমির হোসেনের যাবজ্জীবন সাজার প্রতিবাদে গত রবিবার খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ধর্মঘট শুরু করে চালক-শ্রমিকরা। প্রশাসনের আশ্বাসের পর সোমবার থেকে কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা ছিলো। সাভারের দুর্ঘটনায় সোমবার ট্রাক চালক মীর হোসেনের ফাঁসির রায় দেয়া হয় ঢাকার আদালতে। এ খবর জানাজানি হলে সোমবার রাতেই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ঘোষণা দেয়। এদিকে পরিবহন ধর্মঘটের জন্য দেশের সর্ববৃহত স্থলবন্দর বেনাপোলো আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে অচলবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আটকা পড়েছে কয়েকশত ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান। অপরদিকে ভারত থেকে ফেরত আসা পাসপোর্ট যাত্রীরা বেনাপোল বন্দর এলাকায় আটকে পড়েছেন। শিশু ও রোগীদের নিয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন এসব যাত্রীরা। শুধু বাংলাদেশি পাসপোর্ট যাত্রীরাই নয়, বিপাকে পড়েছেন বিদেশি পর্যটকরাও। বেনাপোলসহ আশেপাশের হোটেল, মোটেলে সিট খালি নেই। অনেকে রোগী এবং শিশুদের নিয়ে পরিবহন কাউন্টারগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন।

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, ঝিনাইদহ, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়া শহর এলাকায় ব্যাটারিচালিত ইজি বাইক চলাচল করলেও শহরের বাইরে চলাচলে বাধা দিচ্ছে শ্রমিকরা। বিভিন্ন স্থানে লাঠি হাতে শ্রমিকরা পাহারা বসিয়েছে। ময়মনসিংহ, চাঁদপুর, রায়পুর, নেত্রকোনা, চট্টগ্রাম, নাটোর, বরিশাল, পিরোজপুর, কুড়িগ্রাম, বাগেরহাট, মোড়েরগঞ্জ, মংলা, খুলনা সিরাজগঞ্জ, নড়াইল, বগুড়া, দিনাজপুর, গাজীপুর, ময়মসিংহ, কুমিল্লা, সিলেট, মুন্সিগঞ্জ, চাপাইনবাবগঞ্জ শহরে একই অবস্থা বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধি ও সংবাদদাতারা।

     গাবতলীতে পুলিশের র‌্যাকারে আগুন: এদিকে গতকাল মঙ্গলবার  রাতে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালের পাশে পুলিশের একটি র‌্যাকার ভ্যানে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ পরিবহন শ্রমিকরা। মিরপুর বিভাগের দারুস সালাম জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) সৈয়দ মামুন মোস্তফা জানান, পরিবহন শ্রমিকরা বিক্ষোভের একপর্যায়ে র‌্যাকার ভ্যানে আগুন দিয়েছে। আগুন এখনো নেভেনি। তিনি আরো জানান, বিকেল থেকে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছিল। তারা একপর্যায়ে গাড়ি ভাঙচুর করে। কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুরের পর পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় তারা পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা র‌্যাকার ও পুলিশ বক্সে আগুন দেয়।

       সর্বশেষ: সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ রাত সাড়ে ৯টায় জানান, শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে, ফলে পরিস্থিতির উন্নতির আপাতত আশা দেখছিনা। শ্রমিক নেতারদের বলেছি বসার জন্য। তবে আমার মনে হচ্ছে না, দু’এক দিনের মধ্যে কোনো ফয়সালা আসবে। কোথায় কারা কারা বসবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা চার-পাঁচজন বসব ঘরোয়াভাবে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে চেয়েছেন তিনি। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সহসভাপতি আব্দুল ওদুদ নয়ন বলছেন, শ্রমিকদের মানানো যাচ্ছে না। আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে কি না জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএএন সিদ্দিক বলেন, শ্রমিকরা যেহেতু আদালতের একটি রায়ের বিপক্ষে গিয়ে ধর্মঘট করছেন, সেখানে আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা এ নিয়ে কারও সাথে কোনো কথাও বলবো না। কোনো ধরনের যোগাযোগ করছি না।