চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের ধাক্কায় আলমসাধু চালক ও কলেজছাত্র আরোহীসহ নিহত ৩

লাটাহাম্বার থেকে মাটি পড়ে পিচ্ছিল রাস্তায় ব্রেক কষে বেকায়দায় শ্যালোইঞ্জিন চালিত অবৈধ যান

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: পিচের রাস্তায় ইটভাটার মাটি পড়ে সৃষ্ট পিচ্ছিল স্থানে নিয়ন্ত্রণ হারানো আলমসাধুর চালকসহ তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন। যে কোচ দেখে শ্যালোইঞ্জিন চালিত আলমসাধু ব্রেক করে নিরাপদ হতে চেয়েছিলো চালক, সেই কোচ ‘চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স’র ধাক্কায়ই প্রাণ হারালেন চালকসহ তিনজন। গতকাল রোববার সকাল ৭টার দিকে চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা সড়কের ব-বিল হক ফিলিং স্টেশনের নিকট এ দুর্ঘটনা ঘটে।
ঘটনাস্থলে আলমসাধু চালক মনিরুল ইসলাম নিহত হন। তিনি আলমডাঙ্গা উপজেলার খোরদ গ্রামের মিনাজ উদ্দীনের ছেলে। আলমসাধু আরোহী দুজন গুরুতর জখম হন। এদের মধ্যে আলমডাঙ্গা দাসপাড়ার পিজির উদ্দিন পাকার ছেলে জসিম উদ্দীন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যায়। দুর্গাপুরের আশাবুল হকের ছেলে আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র লিয়ন মারা যায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে। দুর্ঘটনার পর এলাকার সাধারণ মানুষ যেমন চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বেপরোয়া গতি নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করেছে, তেমনই এলাকার কয়েকটি ইটভাটার জন্য লাটাহাম্বারযোগে নেয়া মাটির কিছু অংশ সড়কে পড়ে সৃষ্ট মৃত্যুফাঁদ থেকেও প্রতিকার প্রত্যাশা করেছে।
জানা গেছে, আলমডাঙ্গা উপজেলার খোরদ গ্রামের মিনাজ উদ্দীনের ছেলে মনিরুল ইসলাম (৪৫) আলমসাধু চালক। গতকাল ৫ মার্চ বেশ সকালে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে আলমডাঙ্গা শহরে ঢোকেন। এ সময় আলমসাধু চালকের পিতা তার গাড়িতেই আলমডাঙ্গা শহরে যান। নিহত আলমসাধু চালক মনিরুল ইসলামের পিতা মিনাজ উদ্দীন বলেন, আলমডাঙ্গা শহরের লালব্রিজ এলাকায় তাকে নামিয়ে দিয়ে ছেলে মনিরুল দশমাইলে যাচ্ছিলেন চাল আনতে। যাওয়ার পথে দুজন যাীি নিয়ে ব-বিল রেলগেটের দিকে রওনা দেন। দুজন যাত্রী হলেন আলমডাঙ্গার পার-দুর্গাপুরের আশরাফুল ইসলামের ছেলে লিয়ন (১৭) ও হারদী দাসপুর গ্রামের ফিজির পাকার ছেলে জসিম উদ্দীন শাহ (৪২)। জসিম উদ্দীন শাহ আলমডাঙ্গার একটি ক্যারামবোর্ড তৈরির কারখানায় কাজ করতেন। তিনি ব-বিল রেলগেট বাজারে নাস্তা করতে যাচ্ছিলেন। তাদের বহনকারী আলমসাধুটি আলমডাঙ্গা-চুয়াডাঙ্গা সড়কের ব-বিল হক ফিলিং স্টেশন ছাড়িয়ে কিছুটা গেলে সামনের দিক থেকে অর্থাৎ চুয়াডাঙ্গার দিক থেকে দ্রুত গতিতে যাত্রীবাহী চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহন ছুটে আসছিলো। দ্রুতগতির বাস ছুটে আসতে দেখে আলমসাধুচালক দ্রুত ব্রেক কষে গতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এ সময় কাদার কারণে আলমসাধুটি সড়কের ওপর ঘুরে যায়। এ সময় চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স আলমসাধুর পেছন দিকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে দুই যাত্রীসহ আলমসাধু চালক মনিরুল ইসলাম সড়কের ওপর আছড়ে পড়েন। ঘটনাস্থলেই মনিরুল নিহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় দুই যাত্রীকে উদ্ধার করে দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। পথিমধ্যে মৃত্যু ঘটে জসিম উদ্দীন শাহ’র। অপর যাত্রী কলেজছাত্র লিয়নকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার অবস্থার উন্নতি না হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। রাজশাহী নেয়ার পথে দুপুর ২টার দিকে লিয়নও মারা যান। ঘাতক বাসটিকে আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ আটক করেছে। আলমডাঙ্গা থানার ওসি আকরাম হোসেন জানান, নিহত আলমসাধু চালক মনিরুলের পিতা মিনাজ উদ্দীন বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় একটি মামলা করেছেন।
তিন তিনজনের তাজা প্রাণ কেড়ে নেয়া সড়ক দুর্ঘটনার পর আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের নাম। গত ২২ ফেব্রুয়ারি চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ ৫জন নিহত মামলার রায়ে চালক জামির হোসেনের যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। নতুন করে আবারও চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের ধাক্কায় তিনজনের প্রাণ বিসর্জনের ঘটনায় সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা গেছে।
তবে সব সমালোচনা ছাড়িয়ে গেছে সড়কের ওপর জমে থাকা কাদার স্তর জমে থাকার বিষয়টি। সড়কের ধারে ইটভাটা নির্মাণ নিষিদ্ধ হলেও চুয়াডাঙ্গার অধিকাংশ ইটভাটা গড়ে উঠেছে রাস্তার পাশে। ফলে ভাটার মাটি বহন বা ভাটায় ট্রাক্টর ও ট্রাক যাওয়া আসার ফলে রাস্তায় কাদামাটি পড়ে। অধিকাংশের অভিমত গতকালের দুর্ঘটনার পার্শ্ববর্তী স্থানে কয়েকটি ইটভাটা রয়েছে। সে সকল ইটভাটার জন্য লাটাহাম্বারে মাটি সরবরাহ করা হয়। লাটাহাম্বারে মাটি বহনের সময় সারা সড়কে তা পড়তে পড়তে যায়। ফলে পাকা কংক্রিটের সড়কে মাটির একটি স্তর পড়েছে। ভোরবেলার সামান্য বৃষ্টি সেই কাদার স্তরে পড়ে পিচ্ছিল কর্দমাক্ততার সৃষ্টি করেছিলো। সামনের দিক থেকে  দ্রুত গতিতে ছুটে আসা বাস দেখে আলমসাধুর চালক দ্রুত ব্রেক কষতে গেলেই ঘটে বিপত্তি। কাদায় স্লিপ কেটে আলমসাধুর চাকার বিপরীত দিকে ঘুরে যায়। ফলে নিয়ন্ত্রণ হারায় আলমসাধুর চালক। ঠিক তখনই প্রচ- জোরে আলমসাধুর  পেছনে ধাক্কা লাগায় বাসটি।
এদিকে, ময়নাতদন্ত শেষে আলমসাধুর নিহত চালক মনিরুল ইসলামের লাশ বাড়িতে নেয়া হয়। রাত ৮টার দিকে জানাজা শেষে গ্রামের গোরস্তানে তার লাশ দাফন করা হয়। নিহত মনিরুল ইসলাম ১ পুত্র সন্তানের জনক।
নিহত জসিম উদ্দীন শাহ’র লাশ গতরাতে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে ছিলো। আজ সকালে বাড়িতে নেয়ার কথা। জসিম উদ্দীন শাহ’র বিয়ে টেকেনি। ফলে তিনি নিঃসন্তান ও সরল-সোজা বাউল ছিলেন। কলেজছাত্র লিয়নের লাশ এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত বাড়িতে পৌঁছেনি।