ক্ষমতায়নের পথে এগোচ্ছেন নারী

আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ

 

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সংসদের উপনেতা, বিরোধীদলীয় প্রধান এবং রাজপথের বিরোধী দলের প্রধান- সবাই নারী। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে একজন নারী কমিশনার যুক্ত হয়েছেন। দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে আকাশচুম্বী সফলতা এনে দেয়ার পর এভাবেই ক্ষমতায়নের পথেও শুরু হয়েছে নারীর অগ্রযাত্রা। সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রের পাশাপাশি রাজনীতিতেও নারীরা গড়ে তুলেছে শক্ত অবস্থান। রক্ষণশীল এ দেশে নারী এখন আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তাবাহিনীতেও ঊর্ধ্বতন পদে আসীন। এমনকি সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর ঝুঁকিপূর্ণ পেশাতেও বাড়ছে নারীর ক্ষমতায়ন। এ অগ্রযাত্রায় পিছে ফেলেছে বিশ্বের সবচেয়ে উদার গণতন্ত্র আর বড় অর্থনীতির দেশগুলোকেও। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের প্রথম ১০ দেশের তালিকায়। অথচ স্বাধীনতার পর এদেশে শিক্ষা, চাকরি, অর্থ উপার্জন, রাজনীতি- সব দিক থেকে পিছিয়ে ছিল নারী। তাদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল নেতিবাচক। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও ছিল না এ দেশে। এ কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার নারীদের তালিকা করেও তা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। অথচ ৪৫ বছর পর সে দেশেই এখন যুদ্ধে নির্যাতিত নারীকে সম্মান জানাচ্ছে দেশবাসী। দেয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদেও নারী আছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটেও নারী উপাচার্য নিয়োগ পেয়েছেন। নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে তারা সবাই তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছেন। প্রশংসিত হচ্ছেন সর্বমহলে। পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বে অধিকারের জন্য কীভাবে লড়তে হয়, কীভাবে নারীর ক্ষমতায়ন করতে হয়, কীভাবে অধিকার নিশ্চিত করতে হয়- সেটি সারা বিশ্বকে শেখাচ্ছে বাংলাদেশ। গত কয়েক বছর ধরেই বিসিএস ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকায় নারীর সংখ্যা বাড়ছে। ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত দুই হাজার ২০ জনের মধ্যে ৬৯৯ জনই নারী। শতকরা হিসেবে যা ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ। কেবল সংখ্যায় নয়, শিক্ষা বাদে ২০টি ক্যাডারে নিয়োগ পরীক্ষার আটটিতেই প্রথম হয়েছেন নারী। আর শিক্ষার ৩০টি বিভাগের মধ্যে ১৩টিতেই প্রথম হয়েছেন নারীপ্রার্থী। বেশ কিছু ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে শতভাগই নারী। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে এত বেশি নারী নিয়োগ পেয়েছেন।
এদিকে হার্ভার্ড ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে করা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘দ্যা গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট, ২০১৫ অনুযায়ী রাষ্ট্রক্ষমতায় নারীর অবস্থান বিবেচনায় সবাইকে পেছনে ফেলে বিশ্বের এক নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নবম এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অষ্টম।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীর অগ্রগতির নানা সূচকে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছে বাংলাদেশ। সার্বিক বিবেচনায় নারী উন্নয়নে বিশ্বের ১৪৫টি দেশের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে ৬৪ নম্বরে। এই তালিকায় ভারতের অবস্থান ১০৮ ও পাকিস্তান ১৪৪ নম্বরে। অথচ ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১ নম্বরে। মাত্র ১০ বছরে দেশ নারী উন্নয়নে যতটা এগিয়েছে, বিশ্বের আর কোনো দেশ এতোটা পারেনি বলে প্রতিবেদনটিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, নারীর স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি উন্নত করা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ জেন্ডার কাউন্সিল প্রোফাইল তথ্য মতে, নারীর ক্ষমতায়নে ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হলেও এখন পর্যন্ত নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি নারীর অভিগম্যতা, নায্যতা, সম্পদের মালিকানা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত অর্জন সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ এমডিজি পর্যালোচনা প্রতিবেদন-২০১৪ অনুযায়ী, অকৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণের লক্ষ্যমাত্র ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করলেও বর্তমানে এই হার মাত্র ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হলেও বর্তমানে সে লক্ষ্যমাত্রা অনেক দূরে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েই গেছে। এখনো পথে বের হলেই নিরাপত্তাহীন তারা। ঘরেও নারী নির্যাতন চলছে সমান তালে। যৌন কিংবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অহরহ। যদিও এর সিংহভাগই ধামাচাপা পড়ে যায় সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে। তবে এরপরও যে চিত্র বিভিন্নভাবে উম্মোচিত হয়েছে তা রীতিমতো গা শিউরে ওঠার মতো। চলতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে মোট ৭৪১ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৭৬ জন এবং জানুয়ারিতে মাসে ৩৬৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপপরিষদে সংরক্ষিত ১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
নারী নির্যাতনের বর্তমান চিত্র সম্পর্কে আক্ষেপ করে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডবিস্নউএলএ) নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, বিচারহীনতা নারী নির্যাতনের সামগ্রিক চিত্র আরও ভয়াবহ করে তুলছে। অপরাধীর মধ্যে ভয় কাজ করছে না। রাজনৈতিক শক্তির অপব্যবহার আর শক্তিশালী জনশক্তির আশ্রয়ে অপরাধীরা ঘাপটি মেরে থাকছে। যতদিন না নারীবান্ধব পরিবেশ ঘরে-বাইরে নিশ্চিত হচ্ছে এবং অপরাধীকে শাস্তির আওতায় না আনা হচ্ছে ততদিন নারী নির্যাতনের চিত্র অপরিবর্তিত থাকবে। যা নারীর ক্ষমতায়নের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

এদিকে নারী নেত্রী ও বিশেষজ্ঞদের অনেকের অভিমত, ক্ষমতাসীন সরকার মুখে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ানোর পক্ষে কথা বললেও বাস্তবিক অর্থে এর বিরোধিতা করছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, (১৯৯৬-২০০১) সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে উল্লেখ ছিল। ৯ম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ১২.২ নং অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ১৯৯৭ এবং জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি ২০০৮-এ এ বিষয়টি উল্লেখ ছিল এবং সর্বশেষ জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি ২০১১ তেও ৩২.৭ নং অনুচ্ছেদে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা ও বর্ধিত সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। বাস্তব চাহিদা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন ব্যবস্থা চালু এবং আসন সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি হয়নি। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতেও কোনো সংশোধন বিল আনেনি। বরং রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে নারীর মৌলিক ক্ষমতায়নের পথকে অস্বীকার করে নারীকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন আয়েশা খানম।

এদিকে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে দেশের প্রধান দুই বড়দলই যে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে রয়েছে সে চিত্রও এখন স্পষ্ট। গত আট বছরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৮ দশমিক ৫১ শতাংশ, বিএনপি ১৩ দশমিক ০৫ ও জাতীয় পার্টি ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ কোটা পূরণ করেছে। অন্যান্য দলের মধ্যে সিপিবি ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ পদে এবং জাসদ (ইনু) ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ অর্জন করেছে। ছোট-বড় কোনো দলই এক-তৃতীয়াংশ নারী নেতৃত্ব গঠনের কাছাকাছিও যেতে পারেনি। অথচ ২০০৮ সালে হওয়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে সব স্তরের নেতৃত্বে ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এই হতাশাজনক চিত্রের পাশাপাশি তৃণমূলের অবস্থা আরও নাজুক। অনেক কমিটিতে নারীর প্রতিনিধিত্বই নেই। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় নারীদের কমিটিতে না নেয়ারও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।