খাদিজা হত্যাচেষ্টা মামলায় বদরুলের যাবজ্জীবন

 

স্টাফ রিপোর্টার: বহুল আলোচিত সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিস হত্যাচেষ্টা মামলায় একমাত্র আসামি ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলমকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেছে আদালত। গতকাল বুধবার দুপুরে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা এ রায় ঘোষণা করেন। আদালতের পিপি মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ এই রায়কে ঐতিহাসিক উল্লেখ করে বলেন, আদালত বদরুলের অপরাধ আমলে নিয়ে তাকে যাবজ্জীবন দন্ডাদেশ দিয়েছেন। একই সাথে ৫ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো দুই মাসের কারাদণ্ড প্রদান করেন। পিপি জানান, মামলায় ৩৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে বদরুলের অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। রায়ে সন্তুোষ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী খাদিজার চাচা আবদুল কদ্দুস। তিনি রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন। মামলার ভিকটিম খাদিজাও রায়ে সন্তুোষ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তবে আসামি পক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবে বলে জানা গেছে। রায়কে আবেগপ্রবণ আখ্যায়িত করে বদরুলের আইনজীবী সাজ্জাদুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, ‘এ রায়ে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আমরা এমন রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। উচ্চ আদালতে আপিল করবো। এদিকে এ রায়ে সন্তুষ্টি জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ব্লুম বার্নিকাট। গতকাল তিনি এক টুইট বার্তায় বলেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবসেই বিচার পেলেন খাদিজা। এ রায় বাংলাদেশে নারী ও মেয়েদের উপর সহিংসতার বিরুদ্ধে বড় আঘাত।

গত বছরের ৩ অক্টোবর সিলেট এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজা বেগম নার্গিসকে চাপাতি দিয়ে উপর্যপুরি কুপিয়ে গুরুতর আহত করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র ও শাবি ছাত্রলীগের সহ-সমপাদক বদরুল আলম। ঘটনার পরপরই শিক্ষার্থীরা বদরুলকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। হামলার পরদিন খাদিজার চাচা আবদুল কুদ্দুস বাদী হয়ে বদরুলকে একমাত্র আসামি করে মামলা দায়ের করেন। পরে  ৫ অক্টোবর বদরুল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলে তাকে কারাগারে প্রেরণ করে আদালত। ঘটনাটি দেশ-বিদেশে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ঘটনার পর শাবি থেকে বদরুলকে প্রথমে সাময়িক ও পরে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিত্সার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে সাক্ষ্য দেন খাদিজা। পরে ১ মার্চ মামলাটি সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত থেকে মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়। ৫ মার্চ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গতকাল ৮ মার্চ আদালত রায়ের তারিখ ধার্য করেন। চাঞ্চল্যকর এই হামলার ঘটনার পাঁচ মাস পর রায় ঘোষণা করা হলো।

আদালতের পর্যবেক্ষণ: মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ‘এদেশে নারীরা এখন নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার কথিত অন্দরমহলের অবরোধ বাসিনী নন। তবে অনেকটা অরক্ষিত। খাদিজার ঘটনা তাই প্রমাণ করে। নারীরা পদে পদে নিগৃহীত, নির্যাতিত, হত্যা ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এজন্য আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও মানসিকতা দায়ী। ৩০ পৃষ্ঠার রায়ে খাদিজাকে ‘অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এক জীবন্ত কিংবদন্তী নারী’ উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‘প্রেমে প্রত্যাখ্যাত পাষন্ড প্রেমিকের চাপাতির নৃশংস আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত খাদিজা দীর্ঘদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে মৃত্যুর কাছে হেরে না যাওয়া সমগ্র বিশ্ব নারী সমাজের প্রতিভূ, বিজয়িনী, প্রতিবাদকারিনী।’ আদালত বলেন, আমার বিশ্বাস আসামীর উপর সর্বোচ্চ শাস্তি আরোপের মাধ্যমে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হাজার হাজার বদরুলরা (উত্যক্তকারীরা) ভবিষ্যতে এমন কান্ড থেকে বিরত থাকবে এবং নারী সমাজ সুরক্ষিত হবে।

আদালত পর্যবেক্ষণে আরো বলেন, আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিবসে খাদিজাকে নৃশংস ও বর্বরোচিতভাবে কোপানোর অভিযোগে আসামি বদরুলের যথোপযুক্ত শাস্তি নারীদের সুরক্ষায় তাত্পর্যপূর্ণ ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। রায়ে বলা হয়, মানব-মানবীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা চিরন্তন। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এমন পৈশাচিক, নৃশংস আচরণ মোটেই কাম্য ও আইন সমর্থিত নয়। এ ঘটনা প্রমাণ করে, খাদিজাকে খুন করার পরিকল্পনা আসামির ছিল। কাজেই আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, রাষ্ট্রপক্ষ আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।

প্রসঙ্গত, শাবি ছাত্র বদরুল এক সময় খাদিজাদের বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসেবে থাকতো। তখন থেকেই খাদিজাকে সে উত্ত্যক্ত করতো। এর পর অভিভাবকরা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। হামলার দিন সিলেটের এমসি কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা ছিল খাদিজার। পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার সময় হামলার শিকার হন তিনি। বদরুলের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মাথার খুলি ভেদ করে মস্তিষ্ক জখম হয়। খাদিজাকে কোপানোর রোমহর্ষক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে তিন দফা অস্ত্রোপচারের পর মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন খাদিজা। তবে শরীরের বা পাশ স্বাভাবিক সাড়া না দেওয়ায় তাকে সাভারের সিআরপিতে তিন মাস চিকিত্সা নিতে হয়।