একশ একটি গরুর লোভে নগদ সব টাকা গোচিয়ে দিয়ে গোবেচারার বিষপান

মোবাইলফোনে জিনের বাদশা সেজে কখনো অভিশাপের ভয় কখনো লোভের টোপ
কামরুজ্জামান বেল্টু/আহসান আলম: একশ একটি গরুর লোভে কাছে থাকা নগদ সব টাকা গোচিয়ে দিয়ে গোবেচারা যখন বুঝেছে সে প্রতারিত হয়েছে, তখন মনের ঘৃণায় নিজেকেই নিজে নিভিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছে। বিষপানে আত্মহত্যার অপচেষ্টা চালানো বেনজিন আহম্মেদ লেজুকে (২৪) চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে। সে মেহেরপুর জেলা সদরের পিরোজপুর ইউনিয়নের নতুন দরবেশপুর স্কুলপাড়ার মৃত ফজলুর রহমানের ছেলে। মোবাইলফোনে জিনের বাদশা সেজে এক প্রতারক সপ্তাখানেকের মধ্যে কয়েক দফায় মোট ৩৪ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়। এরপরই গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে নিজ বাড়ি বসে লেজু বিষপান করে।
জানা গেছে, বেনজিন আহম্মেদ লেজু সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। তিন বছর আগে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ফারহানা আক্তারকে বিয়ে করে। এদের সংসারে রয়েছে দু বছরের এক পুত্র। মাঠে ঘাটা বেনজিন আহম্মেদ লেজুর সংসার তেমন সচ্ছল না হলেও অভাব নেই। সপ্তাখানেক আগে অজ্ঞাত স্থান থেকে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক প্রতারক ০১৯৯৬-৪৮৪২৭৯ নম্বর থেকে লেজুর মোবাইলে ফোন করে। সেলফোনের ভয়েজ অপশনে কণ্ঠস্বর বদলে নিয়ে না পুরুষ না নারীর কণ্ঠে জিন সেজে কথা বলে। প্রথমেই প্রতারক বলে, তোর বাড়িতে অভিশাপ লেগে গেছে। এ অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে হলে রংপুরের মাজার শরিফযুক্ত মসজিদে ১টা জায়নামাজ, ২১টি মোমবাতি ও ২১টি আগরবাতি দিতে হবে। এ কথা শুনে লেজু খানেকটা ভয় পেয়ে যায়। এসব কীভাবে পৌছুবো সেখানে? প্রতারক পরে জানাবো বলে লাইনটা কেটে দেয়। পরদিন আবার একই কৌশলে ফোন করে বিকাশ নম্বর (০১৭০৮৫৩৫৯৪৪) দিয়ে বলে এ নম্বরে বিকাশ করে দে। তোর সব অভিশাপ কেটে যাবে। মুখ দিয়ে রক্ত উঠে তোকে, তোর সন্তানসহ স্ত্রীকে মরতে হবে না। একথা শুনে লেজু ঘরে থাকা তিন হাজার টাকা বাড়াদী বাজারের একটি বিকাশ দোকানের মাধ্যমে বিকাশ করে দেয়। এরপরদিন আবারও প্রতারক একই কৌশলে ফোন দিয়ে বলে, টাকা পেয়েছি। জায়নামাজ, আগরবাতি ও মোমবাতি পেয়েছি। কিন্তু ওসবে তো তোর অভিশাপ কাটছে না, কারণ ওই টাকা মন থেকে দিসনি। তুই আমার সাথে সত্যি কথা না বলে তোর আরো বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। এ কথা শুনে লেজু বলে, তাহলে আমাকে এখন কি করতে হবে। প্রতারক বলে, এখন একটি খাসি, ২১ কেজি চাল দিয়ে রান্নাবান্না করে ওই মাজার সংযুক্ত মসজিদে ছিন্নি করতে হবে। একথার প্রেক্ষিতে লেজু বলে, আমি গরিব মানুষ, এতো টাকা পাবো কোথায়? প্রতারক বলে, মিথ্যা বলতে না করেছি। তোর বাড়িতে লাল রঙের গরু আছে। ওই গরু থাকতেও তুই গরিব বলছিস? তোকে তো গুষ্ঠিশুদ্ধ মরতে হবে। লেজু আরো ভয় পেয়ে যায়। পরদিন তার এক আত্মীয়র মাধ্যমে গরুটি বিক্রির তোড়জোড় শুরু করে। দু মাস আগে ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে কেনা গরুটি ৩৩ হাজার টাকা দিয়ে বিক্রি করে ১০ হাজার টাকা ওই প্রতারকের কাছে বিকাশ করে পাঠায়। এ টাকা পাওয়ার পর রাতে প্রতারক বলে, তোর তো ভাগ্য খুলে গেছে। তোর জন্য ১শ ১টি গরু বরাদ্দ হয়ে গেছে। এই গরু তোর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এজন্য লাগবে গাড়িভাড়া। একশ একটি গরু বলে কথা। গরুগুলো বাড়ি বসে পেতে গোবেচারা লেজু গরু বিক্রির বাকি ২১ হাজার টাকাও বিকাশ করে দেয়। এরপর? যা হওয়ার তাই। প্রতারকের মোবাইলফোনটি বন্ধ। যতোবারই ফোন করা হচ্ছে, একই আওয়াজ, সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এসব ঘটনার বর্ণনা দিয়ে স্থানীয়দের অনেকেই বলেছেন, গরু বিক্রি করার পরও নিকটজনদের কাছে যেমন বেনজিন আহম্মেদ লেজু কারো কাছে কিছু বলেনি, তেমনই যে আত্মীয়র মাধ্যমে গরুটি বিক্রি করেছে সেই আত্মীয় কেন লোকসানে গরু বিক্রি করছে তাও জানতে চায়নি। এসব নিয়ে গতকাল সকাল থেকেই নানামুখি আলোচনা। এতোকিছুর মধ্যে পড়ে সরলসোজা বেনজিন আহম্মেদ লেজু নিজের কষ্ট মেটাতে নিজেই নিজের জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়ার জন্য বিষ কিনে আনে। নিজের ঘরে বসেই বিষপান করে। বিষয়টি পরিবারের সদস্যরা জানার পর তাকে উদ্ধার করে দ্রুত চুয়াডাঙ্গা সর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়েছে। চিকিৎসা চলছে।
বিস্তারিত জানার পর স্থানীয়দের অনেকেরই অনুমান, প্রতারক আশপাশেরই কেউ। মোবাইলফোন ও বিকাশ নম্বরসহ সেলফোন ট্র্যাকিং করলে প্রতারকের মুখোশ খুলবে। এ মুখোশ খোলার জন্য দরকার মামলা, তদন্তে দরকার পুলিশের আন্তরিকতা। এর একটিও কি হবে? হচ্ছে না বলেই তো প্রতারকরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আর সরলসোজা মানুষগুলো সজাগ হচ্ছে না বলেই প্রতারকরা সেই সুযোগ নিচ্ছে।