সেই ৪ শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দুরস্ত বদলির সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি এখনও

চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী রিমু আত্মহত্যা ও বিক্ষোভ পরবর্তী তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন : কারণ দর্শানো নোটিশ

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সেই ৪ শিক্ষকের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত বিভাগীয় মামলা হয়নি। ন্যূনতম বদলির আদেশও দেয়া হয়নি এখন পর্যন্ত। ফলে অভিযোগ উত্থাপনকারী ছাত্রীদের দিন কাটছে অজানা ভয়ে। তবে বিভাগীয় কারণ দর্শানো নোটিশসহ প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুপাতে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

সংশ্লিষ্টসূত্র বলেছে, বিদ্যালয়ের ছাত্র রিমুর আত্মহত্যার পর তার ক্ষুব্ধ সহপাঠীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত  প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির দশ দফা সুপরিশের কিছু ক্ষেত্রে শিথিল করার লক্ষ্যে অভিযুক্তদের তরফে জোর তদবির অব্যাহত রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করা হয়েছে বলেও জোর গুঞ্জন অনেকেরই মুখে মুখে।

চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া সুলতানা রিমু পরীক্ষা দেয়ার সময় শিক্ষকের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানির শিকার হয়। সে বাড়ি ফিরে আত্মহত্যা করে। তার সহপাঠীরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্যালয়ের সামনে সড়ক অবরোধ করে। ছাত্রীদের আন্দোলনের ফলে গঠিত জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পেশ করে। তদন্তে বিদ্যালয়ের চার শিক্ষককে দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়। ১০ দফা সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে প্রেরণ করা হয়। সেখান থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয় গত ৫ ফেব্রুয়ারি। সূত্র বলেছে, এ কারণ দর্শানো নোটিশের জবাব ইতোমধ্যে পেশ করা হয়েছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। এর মাঝে অধিদফতরের পদস্থ কর্তাকে ম্যানেজ করে লঘুশাস্তিতে পার পাওয়ার চেষ্টা চলছে মুখে মুখে গুঞ্জন রটেছে।

প্রসঙ্গত: ছয় সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক। সদস্য হিসেবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ছুফি উল্লাহ, জেলা শিক্ষা অফিসার মিজানুর রহমান, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আজগার আলী, দুজন অভিভাবক মিলনুজ্জামান লাল ও জান্নাতুল ফেরদৌস। তদন্ত কমিটি প্রায় ১০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে পাঁচ দফা সার্বিক মন্তব্য ও ১০ দফা সুপারিশ করেছেন। প্রতিবেদনে পাঁচ দফা মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে- সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির গণিত প্রশ্ন কঠিন হয়েছে বলে তদন্তকারী কমিটি মনে করে। এজন্য প্রশ্নকারী ২ জন শিক্ষক মাসুদুর রহমান (গণিত) ও রহিমা খাতুন (গণিত) দায়ী এবং যারা মডারেশন করেছেন শিক্ষক শামীমা আরা (জীববিজ্ঞান) ও শিক্ষক জেসমিন আরা খাতুন (বাংলা) তারাও দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়েছে। শিক্ষক হাসানুজ্জামান হেদায়েত ছাত্রীদের তার কাছে প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য করতেন অভিযোগ সঠিক মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। শিক্ষক মতিয়ার রহমান, হাসানুজ্জামান হেদায়েত, মজিবর রহমান, সুজিত কুমার ঘোষ ও মামুন অর রশিদ ক্লাসে ছাত্রীদের সাথে অপ্রাসঙ্গিক আচরণ করতেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের হুমকি দেয়ায় এবং আন্দোলন বেগবান হওয়ার জন্য শিক্ষক আমীনুল ইসলাম দায়ী প্রতীয়মান হয়েছে। স্কুলছাত্রী সুরাইয়া সুলতানা রিমুকে পরীক্ষার হলে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ২ মিনিট দাঁড় করে রাখার বিষয়ে শিক্ষক ওয়াহিদা পারভীন দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ১০ দফা সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- শিক্ষক হাসানুজ্জামান হেদায়েত, শিক্ষক মাসুদুর রহমান, শিক্ষক রহিমা খাতুন ও শিক্ষক ওয়াহিদা পারভীন পপি এদের বিরুদ্ধে বদলিসহ বিভাগীয় মামলা করা যেতে পারে শিক্ষক মতিয়ার রহমান, শিক্ষক মজিবর রহমান, শিক্ষক সুজিত কুমার ঘোষ সুমন ও শিক্ষক মামুন অর রশিদ ছাত্রীদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে কোনোরূপ অপ্রাসঙ্গিক আচরণ করতে পারবেন না মর্মে লিখিত নেয়া যেতে পারে। শিক্ষক শামীম আরা, শিক্ষক জেসমিন আরা খাতুন এবং শিক্ষক আব্দুর রহমানকে ভবিষ্যতে প্রশ্ন মডারেশন ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নের আগে আরও যত্নশীল মর্মে তাদেরকে সতর্ক করা যেতে পারে। সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতা দূরীকরণে এবং নিয়মিত পাঠদান নিমিত্তে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। প্রশ্নপত্র প্রস্তুত কমিটি এবং মডারেশন কমিটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক হওয়া এবং ক্লাসে পাঠদান করান এমন শিক্ষকদের মধ্যে থেকে নির্বাচন করা। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষকগণ যেন প্রাইভেট পড়ান সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যেসব ছাত্রী বিক্ষোভ করেছে তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা কোনোভাবেই প্রতিহিংসামূলক বা হয়রানিমূলক আচরণ না করেন সেটি প্রধান শিক্ষক নিশ্চিত করবেন। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের ব্যবহার নিশ্চিত করা। ক্লাসরুমে সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং মনিটরিং করা। বোর্ড বইয়ের বাইরে অন্য বই পড়ানো বন্ধ করা।

উল্লেখ্য, গত ৩ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া সুলতান রিমু গণিত পরীক্ষার প্রশ্ন কঠিন হওয়ায় পরীক্ষায় ভালো না করায় এবং বাড়ি এসে অভিভাবকের কাছে বকুনি খাওয়ায় সন্ধ্যায় আত্মহত্যা করে। পরদিন বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রিমুর আত্মহত্যার প্রতিবাদে বিদ্যালয়ের সামনে দুপুর ১টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত প্রধান সড়ক অবরোধ করে রাখে। জেলা প্রশাসক সায়মা ইউনুসের আশ্বাসে এবং তদন্ত দল গঠন করায় ছাত্রীরা অবরোধ তুলে নেয়। ওই সময় তদন্ত প্রতিবেদন ৭ দিনের মধ্যে দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিলেও তা জমা দিতে দেরি হওয়ায় সম্প্রতি জেলা প্রশাসক বরাবর তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।