গাংনীতে ঘণ্টাব্যাপী পুলিশের অভিযানে অপহৃত কৃষক উদ্ধার

 

দুই অপহরক গ্রেফতার : ফসকে গেছে বাড়ি মালিক ও অপহরণচক্রের হোতা মিন্টু মিয়া

গাংনী প্রতিনিধি: কথায় বলে, অপরাধীরা যতোই শক্তিশালী হোক না কেন, পুলিশের কাছে তারা তুচ্ছ। এর যথার্থতা আবারো প্রমাণ করেছে পুলিশ। দীর্ঘ ৪৫ ঘণ্টা পর জিম্মিদশা থেকে গাংনী থানা পুলিশ উদ্ধার করেছে কৃষক মোশারফ হোসেনকে। পুলিশের তৎপরতার কাছে হার মেনেছে অপরাধীরা। এমনটাই বলছিলেন এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। গতকাল শুক্রবার বিকেলে মেহেরপুর গাংনী উপজেলার ষোলটাকা ইউনিয়নের চেংগাড়া গ্রামের একটি বাড়িতে ঘণ্টাব্যাপী অভিযান চালিয়ে অপহৃত মোশারফকে উদ্ধার করে। এ সময় দুই অপহরককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে অল্পের জন্য ফসকে গেছে বাড়ি মালিক ও অপহরণ চক্রের অন্যতম হোতা মিন্টু মিয়া। গণপিটুনিতে আহত অপহরক চক্রের দুইজনকে গ্রেফতার করে চিকিৎসা দিচ্ছে পুলিশ। এরা হচ্ছে- এ উপজেলার কাষ্টদহ গ্রামের মোমিন মিয়ার ছেলে চিহ্নিত বোমাবাজ জিনারুল ইসলাম (৩৫) ও সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের ঈমান আলীর ছেলে উমেদ আলী (৩২)। বুধবার রাতে চককল্যাণপুর গ্রামের মাঠ থেকে তাকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা।

গাংনী থানা সূত্রে জানা গেছে, বুধবার রাতে অপহরণের পর থেকেই পুলিশ হন্যে হয়ে মোশারফকে জীবিত উদ্ধারের চেষ্টা করছিলো। প্রযুক্তি, স্থানীয় সোর্স ও সম্ভাব্য কয়েকটি ক্লু কাজ লাগিয়ে মোশারফের অবস্থান চিহ্নিত করতে সক্ষম হয় পুলিশ। সেমত গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে এসআই শংকর কুমার ঘোষ, এসআই আবু বক্কর, এএসআই মামুন ও জাহিদ সঙ্গীয় ফোর্সসহ চেংগাড়া গ্রামের আব্দুল গণির বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলে। এক প্রকার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান শুরু হয়। দোতলা বাড়ির নিচতলায় সবগুলো কক্ষ ছিলো তালাবদ্ধ।

অভিযানের বর্ণনা দিতে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, বাড়ি দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেখানে কেউ থাকতে পারে। তবে পুলিশের চোখ বলে কথা। বাড়ির আশেপাশে পড়ে থাকা বিভিন্ন উপকরণ দেখে সন্দেহ ঘনিভূত হয়। নিশ্চিত হতে দোতলার ছাদে পুলিশের কয়েকজন সদস্য উঠে পড়েন। কক্ষের ভেতরে ঢোকার কোনো পথ না পেয়ে দুটি কক্ষের তালাভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। একটি কক্ষের মধ্যে চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় অপহৃত কৃষক মোশারফকে দেখতে পান পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ পরিচয় দিতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন মোশারফ। ওই ঘর থেকেই জিনারুল ও উমেদকে আটক করা হয়। উত্তেজিত গ্রামবাসী এসময় তাদেরকে গণপিটুনি দেয়। তবে অভিযানের কিছুক্ষণ আগেই সেখান থেকে সটকে পড়ে অপহরক চক্রের অন্যতম হোতা গৃহকর্তা আব্দুল গণির ছেলে মিন্টু মিয়া। এলাকা ও পুলিশের খাতায় সে বহু অপকর্মের হোতা হিসেবে পরিচিতি। নানা কাজে বিতর্কিত ও সমালোচিত। এদিকে উদ্ধারের পর চোখ খুলে দেয়া হলেও কিছুই দেখতে পারছিলেন না মোশারফ। তার চোখে-মুখে তখনও ভীতি কাটেনি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে কথা বলতে পারেনি। এক পর্যায়ে মৃদস্বরে অপহরণের বর্ণনা দেন মোশারফ।

মোশারফ হোসেন বলেন, বুধবার রাতে বাড়ির অদূরবর্তী মাঠে সেচ কাজ করার সময় ১০-১২ জন অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত তাকে ধরে চোখ বেঁধে ফেলে। তার সঙ্গীয় আলফাজ উদ্দীনকে মারধর করে ফেলে রাখে। মাঠ দিয়ে কিছুদূর নিয়ে যাওয়ার পর তাকে অপহরণকারীরা তাকে জানায় যে, কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে ভারতে যেতে হবে। তবে মাঠের মধ্যে একই জায়গায় বেশ কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলার চেষ্টা করা হয়। বেশ কয়েক ঘণ্টা হাঁটানোর পর কিছুক্ষণ দৌঁড়ানো হয়। পরে তাকে জানানো হয় ভারতে প্রবেশ করা হয়েছে। একটি পাকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে মিন্টু মিয়ার বাড়ির কক্ষে আটকে রাখা হয়। মাইকে ওয়াজ মাহফিল ও আজানের শব্দ শুনে তিনি বঝুতে পারেন দেশের মধ্যেই আছি। তবে মিন্টুর বাড়িতে ছিলেন একথা তিনি বুঝতে পারেননি। অপহরণকারীরা তার ওপর সব সময় নির্যাতন চালিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পানি ও খাবার চাইলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও মারধর করা হতো। ৩-৪ জন অস্ত্রধারী পর্যায়ক্রমে তার সাথে অবস্থান করেছে। তার নিজ এলাকা থেকে কোনো এক ব্যক্তি ওই সন্ত্রাসীদেরকে নিয়মিত মোবাইলে খবর দিচ্ছিলও বলেও টের পান তিনি। কেন তাকে অপহরণ করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে মোশারফ হোসেন বলেন, মিন্টু ও চিহ্নিত এক সন্ত্রাসী অপহরণের দিন কিছু না বললেও পরদিন তাদের আসল উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে। ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ ও একজনের সাথে বিরোধের জের ধরে তাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে স্বীকার করে সন্ত্রাসীরা। কিন্তু গরিব পরিবারের পক্ষ থেকে এতো টাকা দেয়ার সাধ্য নেই বলতেই মারধর শুরু হতো। জমি বিক্রি করে হলেও টাকা দিতে হবে নয়তো মরতে হবে বলে তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো। তবে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ চাইলে তারা ধরা পড়ে যেতে পারে এই ভয়ে সময় পার করছিলো।

দীর্ঘ ৪৫ ঘণ্টার জিম্মিদশার বর্ণনা দিয়ে তিনি আরো বলেন, তার সাথে থাকা সন্ত্রাসীরা সব সময় তার শরীরে অস্ত্র ঠেকিয়ে রাখতো। জীবিত ফিরতে পারবো এমন আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। সব সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করছিলাম। তারা যে অমানবিক আচার ব্যবহার করেছে তাতে যেকোনো সময় আমাকে মেরে ফেলা হতে পারে বলেই ধরে নিয়েছিলাম।

এদিকে অভিযানের বিষয়ে গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন জানান, চেংগাড়া গ্রামের সন্ত্রাসী মিন্টুর বাড়িতে মোশারফকে রাখা হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েই অভিযান চালানো হয়। তবে মিন্টু সটকে পড়লেও সে ও তার সহযোগীদের গ্রেফতারে জোর চেষ্টা চলছে। তিনি আরো বলেন, তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে মোশারফকে চোখ-হাত বাঁধা অবস্থায় দেখতে পাই। সন্ত্রাসীরা তাকে হয়তো মেরে ফেলার জন্য ঢুকেছে ভেবে জড়োসড়ো হয়ে কাঁপছিলো মোশারফ। তার গায়ে হাত দিয়ে পুলিশ পরিচয় দিতেই সে জড়িয়ে ধরে। একজন মানুষ কতোটা অসহায় ও ভীতির মধ্যে ছিলো তা সহজেই বোঝা যায়। জনতার গণপিটুনির পর মুমূর্ষু অবস্থায় জিনারুল ও উমেদকে উদ্ধার করে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে পুলিশ। পুলিশ প্রহরায় তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে আহত দুজন আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) শরিফুল ইসলাম। উদ্ধার অভিযানের পর পুলিশের একাধিক দল বিভিন্ন স্থানে নতুন অভিযান শুরু করে। অপহরণ চক্রের মূলহোতাসহ সকলকে দ্রুত গ্রেফতার করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ওসি। গ্রেফতার দুজনের মধ্যে জিনারুল চিহ্নিত ডাকাত ও সন্ত্রাসী বলে জানান ওসি। সড়ক ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও বোমাবাজিসহ তার বিরুদ্ধে নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। গাংনী থানায় তার নামে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে ৩টি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ২টি মামলা রয়েছে। অপরদিকে উমেদ আলীর বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে বলে জানান ওসি।

প্রসঙ্গত, গত বুধবার রাতে গ্রামের মাঠে সেচ দেয়ার সময় দুর্বৃত্তরা এ উপজেলার চককল্যাণপুর গ্রামের কৃষক মোশারফকে অপহরণ করে। এ সময় মোশারফের সঙ্গীয় আলফাজ উদ্দীনকে মারধর করে ফেলে রাখে। এ ঘটনায় ব্যাপক পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়। অপহৃতের স্ত্রী গত বৃহস্পতিবার গাংনী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।