শিববাড়ি আস্তানায় সেনা অভিযানে ২ জঙ্গি নিহত

স্টাফ রিপোর্টার: সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি আস্তানায় অন্তত দুই জঙ্গি মারা পড়েছে বলে সেনাবাহিনী জানিয়েছে। তবে ভেতরে আরও জঙ্গি থাকায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। শিববাড়ির পাঠানপাড়ার আতিয়া মহল ঘিরে অভিযানের তৃতীয় দিন গতকাল রোববার বিকেলে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান। তিনি বলেন, অভিযানে ‘ভালো’ ঝুঁকি রয়েছে। ভেতরে অবস্থানরত জঙ্গিরা বেশ কৌশলী। ফলে বলা যাচ্ছে না, কখন অভিযান শেষ হবে। গতকাল জঙ্গিদের অজ্ঞান করতে চেতনানাশক ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ১৪৪ ধারা জারি করে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এর আগে গত শুক্রবার ভোর থেকে এই অভিযান শুরু হয়।

গতকাল কমান্ডোদের গুলিতে দুই জঙ্গি নিহত হয়েছে। এর আগে শনিবার রাতের বোমা বিস্ফোরণে প্রথম দফায় এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ চার জন ও পরে রাত ২টায় ওসমানী হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় নগরীর জালালাবাদ থানার পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম ও কাদিম শাহ মারা যান। এ নিয়ে রবিবার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ৮ জনে। দুই দফা বোমা বিস্ফোরণে র‌্যাব, পুলিশের কর্মকর্তাসহ প্রায় অর্ধশত আহত হয়েছেন। গুরুতর আহতদের মধ্যে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদকে শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় পাঠানো হয়। গতকাল তাকে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়েছে। দক্ষিণ সুরমা থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক জনি লাল দে’র অবস্থা আশঙ্কাজনক।

শনিবার এই অভিযান চলার সময় বিস্ফোরণে ৬ জন নিহত হন। এর মধ্যে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা। নিহতরা হলেন-জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম ও আদালত পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু কয়সার, স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা জান্নাতুল ফাহিম, কলেজছাত্র অহিদুল ইসলাম অপু, নগরীর দাঁড়িয়াপাড়ার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম (৩৮) ও সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার কাদিম শাহ (৩৫)। সকালে কাদিমের স্বজনরা হাসপাতালে এসে লাশ শনাক্ত করেন। এক আত্মীয় জানান, শহীদ আর কাদিম বন্ধু। শহীদের ডেকোরেটর ব্যবসা আছে। সেখানে কাদিমও সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। এক অনুষ্ঠানের কাজ পেয়ে তারা দুজন শনিবার শিববাড়িতে গিয়েছিলেন।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গতকাল বিকেল ৫ টায় এক ব্রিফিং-এ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল হাসান বলেন, ‘ভিতরে একের অধিক জঙ্গি রয়েছে। তাই অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘তারা বাড়িটিতে বিধ্বংসী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা লাগিয়ে রেখেছে। ফলে কমান্ডোদের বেশ সতর্কতার সাথে কাজ করতে হচ্ছে।’ ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন, ‘আমরা রকেট লাঞ্চার দিয়ে দেয়ালে ছিদ্র করে তারপর সেখান দিয়ে ভেতরে টিয়ারশেল ছুড়েছি।’ তারা টিয়ার সেল নিষ্ক্রিয় করার পদ্ধতি জানে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এরপরও তাদের পক্ষে ভেতরে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।’ এখন পর্যন্ত দুজন পুরুষ সদস্য নিহত হয়েছে। এখনও একাধিক জঙ্গি ভেতরে আছে। অভিযান সার্বক্ষণিক চলবে, যতক্ষণ না সমাধান হবে। তিনি আরো বলেন, ‘পুরো এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে।’

দিনভর বিস্ফোরণ-গুলি: গতকাল দিনভর বিস্ফোরণ, গুলি, গ্রেনেডের শব্দে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি তথা গোটা সিলেট প্রকম্পিত হয়। কখনো থেমে থেমে আবার কখনো একনাগাড়ে  গোলাগুলি চলছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিলেট তথা দেশ জুড়ে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। শনিবার গভীর রাতে ঘটনাস্থলে ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা দেয়া হয়। মাইকে করে এলাকাবাসীকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়। মসজিদের মাইকে করে জানানো হয়েছে যে অপরিচিত লোক বা কারো চলাফেরায় সন্দেহ হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে বলা হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে হুমায়ূন রশীদ চত্বর থেকে সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়ক দিয়ে যাতায়াত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শিবাবাড়ি, পাঠানপাড়া, গুটাটিকর, মেমিনখলাসহ বেশ কয়েকটি মহল্লার মানুষ এখন কার্যত বন্দী। তারা গ্যাস, পানি, বিদ্যুত না পেয়ে কষ্টে পড়েছেন। জঙ্গি অভিযানের অংশ হিসেবে সেখানে এসবের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে গত শুক্রবার থেকে। একই কারণে বেশ কয়েকটি মিষ্টান্ন ও বেকারি সমাগ্রী প্রস্তুতকারী কারখানা বন্ধ থাকায় কয়েকশত শ্রমিক বেকার রয়েছে তিন দিন থেকে। শহরে প্রবেশ পথসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় চেকপোষ্ট বসানো হয়েছে।

এদিকে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ইউনিট, সোয়াত, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, পুলিশ-র‌্যাব জঙ্গিদের জীবিত ধরার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিন্ত জঙ্গিরা আত্মসমর্পণ করছে না। উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ধারণা আতিয়া মহলের নিচতলার ফ্লাটে ভারী অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক রয়েছে। বাড়িতে বিধ্বংসী ব্যবস্থা নিয়ে জঙ্গিরা অবস্থান নিয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সকাল ১০টা থেকে বেলা পৌনে ৩টা পর্যন্ত আতিয়া মহল ও তার আশেপাশের এলাকায় চারটি শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এর মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ বিস্ফোরণটি খুবই শক্তিশালী ছিল । বিস্ফোরণের পর গোটা এলাকা কেঁপে ওঠে এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এলাকা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। বিকেল সোয়া ৩টা পর্যন্ত গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। বেলা ১২ টার দিকে একটি বিস্ফোরণে আতিয়া মহলের পলেস্তেরা খসে পড়ে বলে স্থানীয়রা জানান। ভোরের দিকেও গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার জেদান আল মুসা জানান, উদ্ধার করা ৭৮ জনকে পরিবারের কাছে দেওয়া হয়েছে।

স্বজনদের কণ্ঠে ক্ষোভ: সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মধ্যে জোড়া বিস্ফোরণে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কার পাশাপাশি গাফিলতির অভিযোগ এনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নিহত এক পুলিশ কর্মকর্তার বোন প্রশ্ন রেখেছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই যদি এভাবে মারা যান, তাহলে দেশের মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া হবে কিভাবে। গতকাল সকালে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে। পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে তাদের অনেকেই দিশেহারা। হাসপাতালের মর্গে কথা হয় পরিদর্শক মনিরুল ইসলামের ভাই সাইফুল ইসলামের সাথে। আবেগতাড়িত সাইফুল অভিযোগ করেন, ‘ঘটনাস্থলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এত সদস্য থাকার পরও জঙ্গিরা হামলা চালাতে পেরেছে গাফিলতির কারণে। এখানে র‌্যাব ছিলো, সেনাবাহিনী ছিলো। ওরা আজ তিন দিন ধরে কি করছে?’