বড়হাটে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নারীসহ তিন জঙ্গি নিহত

 

অপারেশন ম্যাক্সিমাস সমাপ্ত : শিববাড়ি বিস্ফোরণে প্রধান হোতা বড়হাটে নিহত : মনিরুল

স্টাফ রিপোর্টার: মৌলভীবাজার শহরের (দ্বিতীয় জঙ্গি আস্তানা) বড়হাটে পরিচালিত অভিযান অপারেশন ম্যাক্সিমাস আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে। ভেতরে থাকা তিন জঙ্গি আত্মঘাতী হয়ে নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। গতকাল বড়হাটের হোসেন কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, তিন জঙ্গির মধ্যে দুজন পুরুষ ও এক নারী রয়েছে। নিহত জঙ্গিদের নাম পরিচয় এখনো তারা নিশ্চিত হতে পারেননি বলে জানান। গত শুক্রবার সকাল দশটার দিকে অভিযান শুরু করেছিল সোয়াত টিম। অভিযান শেষ হয় বেলা ১২টার দিকে।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, নিহতদের মধ্যে একজন আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলাকালে অদূরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিরীহ মানুষ ও পুলিশ-র‌্যাব কর্মকর্তাদের হত্যার সাথে জড়িত ছিলো। নিহত ৩ জঙ্গির লাশ সুরতহাল রিপোর্ট শেষে গতকাল বিকালে ময়না তদন্তের জন্য মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যার হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। আজ রোববার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন ও নিহতদের ডিএনএ’র নমুনা সংগ্রহ করা হবে। মনিরুল ইসলাম বলেন, আপনাদের আগে আমরা জানিয়েছিলাম বড়হাটের জঙ্গি আস্তানায় অভিযান জটিল। কারণ আমাদের কাছে তথ্য ছিলো, আতিয়া মহলের অদূরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা আবার বড়হাটের আস্তানায় নিরাপদে ফেরত আসতে পেরেছিলো। তাই সেখান থেকে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম এখানে বোমা ও বেশ কিছু বিস্ফোরকসহ মিড আপার ফিল্ড লেভেলের বিশেষজ্ঞ জঙ্গি রয়েছে। আমরা আগেই জানতে পেরেছিলাম বড়হাটে তিনজন অবস্থান করছে। এদের মধ্যে দুইজন পুরুষ ও একজন মহিলা। এখানে তিনজনের মধ্যে যে সিলেটে গেছে এবং ঘটনা ঘটিয়ে নিরাপদে ফিরে এসেছে আমরা তার উপস্থিতি (বড়হাটে) জঙ্গি আস্তানায় কনফার্ম করতে পেরেছিলাম। মনিরুল আরো বলেন, শুক্রবারও আপনাদের বলেছিলাম এখানে অনেকগুলো ভবন রয়েছে। ভবনের ভিতরে আবার অনেকগুলো কামরা ছিল। কামরায় বিস্ফোরক সেট করে রেখেছিল জঙ্গিরা। প্রথম দিনেই পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়েই একজন মহিলা জঙ্গি বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠে পুলিশকে লক্ষ্য করে দুইটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এর একটি বিস্ফোরিত হয়েছিল এবং একটি এখনো অবিস্ফোরিত অবস্থায় ধান ক্ষেতে পড়ে আছে। যেটি বিস্ফোরিত হয়েছিল সেটি অনেক ক্ষমতাসম্পন্ন। তাই বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে আমাদের সোয়াত টিমকে আগাতে হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই অভিযান সফল করা। আমরা সেটা করতে পেরেছি। তবে তাদেরকে জীবিত ধরার চেষ্টা ছিল। এই জন্য তাদের আমরা আহবানও করেছিলাম আত্মসমর্পণ করার জন্য। তাদের আত্মসমর্পণ করানোর জন্য যখনই সোয়াত কাছে যাবার চেষ্টা করেছে তখনই তারা সোয়াতের দিকে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, শুক্রবার যখন আমরা সন্ধ্যা ৭টায় অভিযান আপাতত স্থগিত করে ফিরছিলাম তখন আমরা দেখলাম তারা আবার সোয়াত সদস্যদের হামলার উদ্দেশে দুইটি শক্তিশালী গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বিস্ফোরণে আমরা ভবনে ধোঁয়া উড়তে দেখেছি। আমাদের ধারণা ছিল, ভবনটিতে আগুন ধরে গেছে। তিনি বলেন, আমরা গতকাল শনিবার যখন ভবনে প্রবেশ করে দেখেছি- অভিযানকালেই তারা নিহত হয়েছে। যেখানে আগুন ধরেছিল সেখানে আমরা ৩টি ডেড বডি দেখতে পেলাম। এদের দুইজন পুরুষ এবং একজন মহিলা। মনিরুল ইসলাম আরো বলেন, আমরা মনে করি সিলেটে র্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তাসহ সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন, ‘যাদের মধ্যে একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থীও ছিল, তাদের হত্যার যে বিচার তা তাত্ক্ষণিকভাবে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়ে গেছে।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানায় ৪ শিশু ছিলো। ৩ জঙ্গি সুইসাইডাল ভেস্ট পরে শিশুদের ঘিরে ফেলে এবং নিজেদের শরীরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ওই চার শিশুকে হত্যা করে। নিজেদের শিশুদেরও এরা রেহাই দেয়নি। এরা এতটাই জঘন্য, এরা দৈত্য, দানব শ্রেণির, মানবতাবিরোধী। এরা মানুষ নয়। সিটিটিসির উপ-কমিশনার (ডিসি) মহিবুল ইসলাম খান বলেন, আস্তানার ভেতরের একজন পুরুষ ও একজন নারীর লাশ বাথরুমের মধ্যে ছিলো। বাথরুমের পাশেই ছিলো আরেকজনের লাশ। তিনি বলেন, আমরা ধারণা করছি, বাথরুমের নারী-পুরুষ দুজনই স্বামী-স্ত্রী। তাদের তুলনায় অন্য জঙ্গির বয়স কিছুটা কম। আমরা তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা করছি। অভিযানে অংশ নেয়া সিটিটিসির কর্মকর্তাদের ধারণা, রাতের কোনো এক সময়ে জঙ্গিরা এক্সপ্লোসিভ বিস্ফোরণের মাধ্যমে আত্মঘাতী হয়েছে। এর আগে তারা আস্তানার ভেতরে থাকা গুরুত্বপূর্ণ নথি ও নগদ অর্থও পুড়িয়ে ফেলে। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই অভিযানের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে বক্তব্য রাখেন পুলিশের সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি কামরুল আহসান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের ডিসি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শাহাজালাল প্রমুখ। সফল অভিযানের সংবাদে জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। শহরে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের ফলে খুলেছে দোকানপাট। শুরু হয়েছে যান চলাচলও। এর আগে শহরের বড়হাটের জঙ্গি আস্তানার ভেতরে ১১টা ৩৪ মিনিটে বিকট একটি বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। এর আগে ঘণ্টা দেড়েক প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। শনিবার সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে সোয়াট ফের অভিযানে যোগ দেয়। ১০টা ৮ মিনিটে ডিআইজি, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম ও বোম্ব ডিসপোজাল দল অভিযান স্থলে প্রবেশ করেন। গত বুধবার মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের সরকার বাজার এলাকার নাসিরপুর ও পৌর শহরের বড়হাট এলাকার দুই জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরু করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সোয়াট টিম। দুটি বাড়ির মালিক এক লন্ডন প্রবাসী বলে জানায় পুলিশ। জঙ্গিরা ‘প্রাণ-আরএফএল’ কোম্পানির কর্মকর্তা পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছিলো বলে জানান বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক।