বিজলি বাতি জ্বললেই সমাজকে কি আলোকিত বলা যায়?

 

সাপে কেটে ছেলের মৃত্যুর ১০ মাসের মাথায় একইভাবে মায়ের মৃত্যুর আড়ালে যেমন কোনো অভিশাপ নেই, তেমনই সাপে কাটার পর ওঁঝা ডেকে ঝাড়ফুঁকের নাটকের মধ্যেও নেই কোনো সচেতনতার লেশ। অভিশাপ নিয়ে কাতরতা আর অপচিকিৎসায় অন্ধবিশ্বাসের অপর নাম কুসংস্কার। যে সমাজ কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সেই সমাজকে কি সুন্দর বা আধুনিক সমাজ বলা যায়? বৈদ্যুতিক বাতি জ্বললেই সমাজকে আলোকিত বলা চলে না, আলোকিত সমাজ মানে সচেতনতার আলোয় আলোকিত হওয়া।

সাপে কাটা মানেই মৃত্যু নয়। সব সাপের যেমন বিষ থাকে না, তেমনই সব সময় সব সাপ দংশন করলেও বিষ প্রয়োগ করতে পারে না। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েই মূলত এক শ্রেণির ওঁঝা কবিরাজের দল ঝাড়ফুঁকের নাটক করে অর্থ হাতিয়ে নেয়। বিষধর সাপে দংশন করে বিষপ্রয়োগ করেছে এমন রোগীর একজনও কি ওই ওঁঝা-কবিরাজ সুস্থ করতে পেরেছে? যখনই না পারে তখনই অভিশাপসহ জিনসাপে দংশন করেছে বলে ভীতিকর উক্তি আওড়ে সটকে পড়ে ওঁঝা কবিরাজ। বিষপ্রয়োগ করতে পারেনি বা যে সাপে দংশন করেছে তার বিষই নেই এমন রোগী নিয়ে ওঁঝা-কবিরাজ নানা নাটক করে, সনাতন পদ্ধতির সেই পুস্তক বের করে উঁচিয়ে ধরে বাহবা নেয়। আর সাপে দংশন করলে নিয়ম মেনে বাঁধন দেয়ার পর যতো দ্রুত নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে নেয়া যায় ততোই রোগীকে সুস্থ করে তোলার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। সাপে কাটা বহু রোগী হাসপাতালে এন্টিস্নেক ভেনম দিয়ে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়েছে, হচ্ছে। এই বিষয়গুলো না জানা মানে আধুনিক বিজ্ঞান যুগেও নিজেকে পিছিয়ে রাখা। এই সমাজেরই একটি গ্রামের নাম পাইকপাড়া। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামে কি একজন সচেতন মানুষও নেই যে তিনি সাপে কাটা রোগীকে নিয়ে ওঝা কবিরাজের ঝাড়ফুক নাটকের বদলে হাসপাতালে নেয়ার তাগিদ দেবেন? হয়তো আছে, হয়তো নেই। থেকেও অনেকে সে দায়িত্ব নিতে চান না। কারণ, পাছে অপ্রীতিকর বা অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে গেলে জীবনভর অপবাদ বয়ে বেড়াতে হবে। না, বিজ্ঞান যুগে এই অপবাদের ভয়ে সচেতন মানুষকে মুখ ঘোরালে যেমন চলে না, তেমনই স্বাস্থ্য বিভাগসহ বন বিভাগের বন্য পশু সম্পর্কে অন্ধ করে রাখা কল্যাণকর হতে পারে না। একইভাবে একজন রোগীর কোনো ওঁঝা কবিরাজর প্রতারণায় মারা যাক তাও নিরবে মেনে নেয়া মানে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়। অন্যায় করে কেউ পার পেলে অন্যায়ের প্রবণতা দূর হবে কীভাবে? সে ক্ষেত্রে প্রশাসন পুলিশের অগ্রণী ভূমিকা পালন তথা আইন প্রয়োগে উদাসিনতা বা অজুহাতে দায় এড়ানোর মানসিকতা পরিহারে শুদ্ধি অভিযান প্রাসঙ্গিক নয় কি?

পড়শি দেশে সাপ দূরের কথা বাঘ মারাও দণ্ডনীয় অপরাধ। এ আইন শুধু খাতা কলমে নয়, বাস্তবে যথাযথভাবে প্রয়োগও হয়। ফলে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে সর্বস্তরের মানুষ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়। একইভাবে বন্য প্রাণীর দংশন বা আক্রমণে প্রাণহানি বা বড় ধরনের ক্ষতি হলে সরকার তা পোষাতে কালবিলম্ব করে না। অথচ আমাদের দেশে? সাপে কাটলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে তা না জেনে ওঁঝা কবিরাজের প্রতারণার শিকার হয়ে পা বাড়ায় মৃত্যুর দিকে। এ লজ্জা, এ কষ্ট দূর হবে কতোদিনে?