প্রটোকল ভেঙে হাসিনাকে স্বাগত জানালেন মোদী

 

আমরা দুইজন সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাবো : মোদীর টুইট

স্টাফ রিপোর্টার: দীর্ঘ সাত বছর পর চারদিনের তাত্পর্যপূর্ণ ভারত সফর শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শুক্রবার নয়াদিল্লির পালাম বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছুলে সবাইকে অবাক করে প্রটোকল ভেঙে তাকে অভ্যর্থনা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অভ্যর্থনা জানাতে নরেন্দ্র মোদীর এই উপস্থিতি ঢাকা-দিল্লির বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক সম্পর্ককে আরো বহুমাত্রিক রূপ দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। আজ শনিবার নরেন্দ্র মোদীর সাথে দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে আনুষ্ঠানিক আলোচনা ও একান্ত বৈঠকে অংশ নেবেন শেখ হাসিনা। বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৩০টির বেশি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে। গতকাল শুক্রবার ভারতীয় সময় দুপুর ১২টার দিকে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আকাশ প্রদীপ নয়াদিল্লির পালাম বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছায়। সেখানে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানোর কথা ছিলো ভারতের হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড পাবলিক এন্টারপ্রাইজ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এবং বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর। কিন্তু সবাইকে অবাক করে প্রটোকল ভেঙে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির হন নরেন্দ্র মোদী। বিমানের গেটে উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান তিনি। এ ঘটনাকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গোপাল বাগলে একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর প্রতি উষ্ণ অভ্যর্থনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

প্রসঙ্গত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী এর আগে ২০১৫ সালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং গত জানুয়ারিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানকে প্রটোকল ভেঙে শুভেচ্ছা জানান। দুই প্রধানমন্ত্রীর কুশল বিনিময়ের পর শেখ হাসিনার হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেন বাবুল সুপ্রিয়। এ সময় দিল্লিতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী এবং ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা উপস্থিত ছিলেন। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর শেখ হাসিনাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেন নরেন্দ্র মোদী। বিমানবন্দর থেকে শেখ হাসিনাকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যনিয়ে যাওয়া হয় রাইসিনা হিলে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে। এই সফরে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির অতিথি হিসেবে রাষ্ট্রপতি ভবনে অবস্থান করছেন তিনি। পরে শেখ হাসিনার হাতে ফুল তুলে দেয়ার ছবি টুইট করে মোদী লিখেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে পেরে আমি আনন্দিত। আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমি সংকল্পবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর উপলক্ষে দিল্লি শহরকে সাজানো হয়েছে। শহরের বিভিন্ন সড়ক ও প্রান্তে উড়ছে দুই দেশের পতাকা। শোভা পাচ্ছে দুই প্রধানমন্ত্রীর ছবি। আজ শনিবার সকাল নয়টায় রাষ্ট্রপতি ভবনে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা গ্রহণের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচি শুরু করবেন শেখ হাসিনা। অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদী তাকে স্বাগত জানাবেন। ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল শেখ হাসিনাকে গার্ড অব অনার দেবে। তিনি গার্ড পরিদর্শন করবেন। দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে দুই প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক আলোচনা ও একান্ত বৈঠক আজ নয়াদিল্লির রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন হায়দ্রাবাদ হাউসে অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে সাত বছর ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই হচ্ছে না- এ কথা আগেই জানানো হয়েছে। তবে কবে নাগাদ এই চুক্তি সম্পন্ন হবে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উপস্থিতিতে তা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হবে। বাংলাদেশ চায় চলতি বছরের মধ্যেই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হোক।

বৈঠকের পর দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ৩০টির বেশি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। পাশাপাশি দুই প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিরল-রাধিকাপুর রুটে মালবাহী ট্রেন চলাচল, খুলনা-কোলকাতা রুটে যাত্রীবাহী বাস ও রেল চলাচল এবং ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুত প্রকল্প থেকে বাংলাদেশে অতিরিক্ত ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত সরবরাহ উদ্বোধন করবেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিসহ বাংলাদেশ সীমান্ত সংশ্লিষ্ট ভারতের রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। দুই প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর হিন্দি সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করবেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব ভারতীয় সেনাসদস্য শহীদ হয়েছেন তাদের মরণোত্তর মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দেয়া হবে। নয়াদিল্লির মানেক শ সেন্টারে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণোত্সর্গকারী ১৬৬১ জন ভারতীয় সেনাসদস্যের মধ্যে সাতজনের নিকটাত্মীয়ের হাতে শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পদক ও সম্মাননাপত্র তুলে দেবেন। অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদিও বক্তব্য রাখবেন। গতকাল সন্ধ্যায় নয়াদিল্লির চানৈক্যপুরীতে বাংলাদেশ হাইকমিশন শেখ হাসিনার সম্মানে এক সংবর্ধনার আয়োজন করে। এতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে সম্মাননাপ্রাপ্ত ভারতীয়রা এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া ভারতীয় সৈনিকদের পরিবারের সদস্যরা যোগ দেন।

প্রধানমন্ত্রী রোববার আজমির শরিফে যাবেন ও সেখানে খাজা মাইনুদ্দিন চিশতির মাজার জিয়ারত করবেন। এছাড়া ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি, কংগ্রেস নেত্রী প্রধান সোনিয়া গান্ধীর সাথে বৈঠক করবেন তিনি। কাল রাতে রাষ্ট্রপতির দেয়া নৈশভোজে অংশ নেবেন শেখ হাসিনা। সোমবার নয়াদিল্লির হোটেল তাজমহলে ব্যবসায়ীদের একটি সেমিনারে অংশ নেবেন তিনি। ওই দিন সকালে ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দেবেন শেখ হাসিনা। সোমবার বিকেলে ঢাকায় ফিরে আসবেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা ত্যাগ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সকাল ১০টা ১০ মিনিটে নয়াদিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আসম ফিরোজ, তিন বাহিনী প্রধানগণ, ডিপ্লোমেটিক কোরের ডিন, উচ্চ পর্যায়ের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান।

প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীর মধ্যে রয়েছেন- মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক, পররাষ্ট্র মন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী মো. আমিনুল ইসলাম, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক, তথ্য সচিব মর্তুজা আহমেদ এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিমও সফর সঙ্গীদের মধ্যে রয়েছেন। দৈনিক সমকালের সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, দৈনিক জাগরণের সম্পাদক আবেদ খান, বাসস’র প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, দৈনিক সংবাদের সম্পাদক আলতামাস কবীর, দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় ও দৈনিক ইত্তেফাকের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আশিস সৈকত প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে দিল্লি গেছেন। এছাড়া এফবিসিসিআই-এর সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমেদের নেতৃত্বে ২৫৭ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল সফরসঙ্গী হিসেবে রয়েছেন।