নববর্ষ উপলক্ষে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে সোলা পল্লির কারিগরদের বেড়েছে ব্যস্ততা

 

কালীগঞ্জ প্রতিনিধি: বাংলা নববর্ষ সামনে, তাই ব্যস্ততা বেড়েছে সোলা পল্লির কারিগরদের। দিন-রাত তাদের বিশ্রাম নেই। সোলা দিয়ে তৈরি করছেন দর্শনীয় সব ফুল আর ফুলের মালা। যা দিয়ে সাজবে বাংলার তরুণ-তরুণী আর বরণ করবে নববর্ষকে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নরদিহি গ্রামের সোলার কারিগররা এই নববর্ষে বেলি, গোলাপ, জুই, জিনিয়া, পদ্ম, গন্ধরাজ ফুল আর ফুলের মালা তৈরিতে বেশি ব্যস্ত। এগুলোর চাহিদার যেন শেষ নেই।

কারখানার বর্তমান মালিক তোফায়েল হোসেন জানান, তারই ভগ্নিপতি শারীরিক প্রতিবন্ধী সিরাজুল ইসলাম গ্রামে ২০০৪ সালে গড়ে তোলেন এই সোলার কারখানা। যে কারখানা গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। শতাধিক নারী, কিশোর-কিশোরী মূল কারখানায় ও বাড়িতে বসেই ফুল তৈরি করছেন। মহিলারা অবসরে কাজ করে অর্থ উপার্যন করছেন। তবে শারীরিক কারণে কারখানার প্রতিষ্ঠাতা অবসর নিয়েছেন। এখন তোফায়েলই এটার মালিক।

তোফায়েল হোসেন জানান, সিরাজুল ইসলাম কোলকাতায় থাকাকালে এই সোলা দিয়ে ফল তৈরির কাজ শেখেন। এরপর তারই ইচ্ছাতে তোফায়েল হোসেনকে সাথে নিয়ে ২০০৪ সালে ফুল তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন। নাম দেন রিগ্যাল হ্যান্ডিক্রাফ্টস অ্যান্ড ড্রাই ফ্লাওয়ার। ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার নরদিহি গ্রামে গিয়ে দেখা যায় তোফায়েল হোসেনের বাড়ির কারখানা ছাড়াও বিভিন্ন বাড়িতে চলছে সোলা দিয়ে তৈরি ফুল তৈরির কাজ। কারখানার কাজের জন্য আগে থেকেই সোলা সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।

তোফায়েল জানান, প্রথম বছর ৫ জনকে তারা ফুল তৈরির প্রশিক্ষণ দেন। কিভাবে সোলা কেটে আকর্ষনীয় সব ফুল ও ফুলের মালা তৈরি হয়। আনোয়ার হোসেন, জাহিদুল ইসলাম, রুনা পারভিন, ময়না খাতুন ও শাহনাজ পারভিনকে তিন মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মের উপযুক্ত করে তোলেন। এরপর পর্যায়ক্রমে শতাধিক নারী-পুরুষকে তারা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

তোফায়েল হোসেন আরও জানান, প্রথমে সকলের কাজটি কঠিন ভেবে আসতে চাইতো না। এখন তারা দেখছেন এটা খুবই সহজ। যে কারণে বর্তমানে তার কারখানায় ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করছেন।

কিশোরী আসমা খাতুন জানান, তার বাবা মনির উদ্দিন মারা গেছেন। খুবই কষ্টে চলে তাদের সংসার। তিনি নিজে অনার্স পড়ছেন। এই অবস্থায় তার নিজের পড়ালেখার খরচ জোগাড় করতে হয়। তিনি জানান, ২০১০ সাল থেকে এই কারখানায় কাজ করছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি মাসে তার ৩ হাজার টাকা আয় হয়। এই টাকা দিয়ে নিজের পড়ার খরচ জোগাড়ের পাশাপাশি কিছু পয়সা জমিয়েছেন আসমা। আরেক কিশোরী রাজিয়া খাতুন জানায়, সে নবম শ্রেণিতে পড়ালেখা করে। অবসর সময়ে এখানে কাজ করতে আসে। এতে তার পড়ার খরচের পাশাপাশি সংসারেও সচ্ছলতা আনতে সহযোগিতা করছে। রিনা বেগম জানান, স্বামীর একার আয়ে যখন সংসার ঠিক মতো চলছিলো না, ঠিক তখনই এই কারখানায় কাজ নেন। এখন তাদের সংসার ভালোই চলছে। মাসে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা আয় করা যায়। তিনি জানান, বেলি, রজনীগন্ধা, গোলাপ, মিনি গোলাপ, চন্দ্রমলি¬কা, চামেলি, কচমচ, জিরোসহ ৪৫ প্রকারের ফুল তৈরি করেন এই সোলা দিয়ে। তিনি আরও জানান, সোলা ফুলের চাহিদা বারো মাসই থাকে, তবে পহেলা বাংলা নববর্ষ এলে এই চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এবারও বেশ কিছু ফুলের অর্ডার এসেছে। নরদিহি গ্রামের সাবিনা খাতুন জানান, তারা এখান থেকে কাজ বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে পরিবারের সকলেই অবসর সময়ে কাজ করেন।

তোফায়েল আহম্মদ জানান, বর্তমানে তাদের বাড়িতে ছাড়াও গ্রামের বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে তাদের এখান থেকে সোলা নিয়ে বাড়িতে বসে ফুল তৈরি করছেন। তিনি আরও জানান, ফুল তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে সোলা কেটে কাগজ তৈরি করতে হয়। এই কাগজ দিয়ে রোল বানানো হয়। ফুল তৈরির ক্ষেত্রে শ্রমিকরা ভিন্ন ভিন্ন পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। তবে প্রতিদিন একজন শ্রমিক এক থেকে দেড়শ’ টাকা আয় করেন। মাসে তার কারখানা থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি হয়। তিনি এই কাজে মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করেন। তোফায়েল হোসেন জানান, কয়েকবার আন্তর্জাতীক প্রতিবন্ধি দিবসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মেলায় স্টল দিয়েছেন তারা। জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারও পেয়েছেন। তবে অর্থের অভাবে কারখানা বড় করতে পারছেন না। সহজ শর্তে ঋণ দিলে কারখানা বড় করে অনেকের কর্মসংস্থান করতে পারবেন বলে আশা করেন তিনি।