ঐতিহাসিক মুজিবনগর কমপ্লেক্স লোকবল অভাবে অরক্ষিত

 

মাজেদুল হক মানিক/শেখ শফি: মেহেরপুর ঐতিহাসিক মুজিবনগর কমপ্লেক্স স্বাধীনতার ইতিহাসের এক অমূল্য স্মারক। একাত্তরের বাংলাদেশকে তুলে ধরার জন্য নির্মিত হয়েছে নানা স্থাপনা। তবে নির্মাণ শুরুর দীর্ঘ ১৯ বছর পেরিয়ে গেলেও রয়েছে অপূর্ণতা। অপরদিকে লোকবলের অভাবে এসব স্থাপনা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্য ব্যহত হচ্ছে।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর তথা বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নিয়েছিলেন। যার মধ্যদিয়ে যুদ্ধরত বাঙালিদের সহযোগিতা করে বিভিন্ন দেশ। এই সরকারের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষে শপথের স্থানে নির্মিত হয় স্মৃতি সৌধ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করে নানা স্থাপনা তৈরির একটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করে। কয়েক দফা নকশা ও বাজেট পরিবর্তন করে নির্মাণ কাজ চলতে থাকে। উল্লেখ্যযোগ্য স্থাপনার মধ্যে- মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কেন্দ্র, মিউজিয়াম ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে।  মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণপূর্ত অধিদফতর নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করছে। তবে নির্মাণ শুরুর দীর্ঘ ১৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এর পূর্ণতা পায়নি। কবে নাগাদ তা সম্পন্ন হবে সে খবরও জানে না স্থানীয় গণপূর্ত কর্মকর্তারা। তবে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া স্থাপনাগুলো দেখভালে লোকবল নিয়োগ হয়নি। প্রতি বছর মুজিবনগর দিবস সামনে রেখে স্থানীয় প্রশাসন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করে। বছরের বাকি সময় অনেকটাই অরক্ষিত থাকে মুজিবনগর কমপ্লেক্স। আম গাছগুলোও পরিচর্যা হচ্ছে না। অনেক গাছ শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বিলিন হতে চলেছে প্রথম সরকারের সাক্ষি শতবর্ষী এসব আমগাছ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বছর চারেক আগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্মৃতিকেন্দ্রের কাজ পরিদর্শন করেন। কেন্দ্রটির নির্মাণ দ্রুত শেষ করা, দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে ২০টি পাবলিক টয়লেট ও টিউবঅয়েল স্থাপন এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতিসংবলিত একটি ফটক নির্মাণের জন্য তারা বাজেট ও পরিকল্পনা প্রেরণের নির্দেশ দেন। তাদের নির্দেশনা মতো ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে ২০১৪ সালে মেহেরপুর গণপূর্ত ওই সময়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান উল্লাহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রদান করেন। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ পেয়েছেন কি-না তা জনেন না বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী। বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কাজ প্রায় শেষ। তবে কি কাজ শেষ হয়েছে সে সম্পর্কে তিনি কোনো ধারণা দিতে পারেননি। দায়সারাভাবে তথ্য দেন তিনি।

মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স, দেশের সর্ববৃহৎ মানচিত্র, প্রশাসনিক ভবন, অডিটোরিয়াম, প্লাজা, ছয় স্তর বিশিষ্ট গোলাপ বাগান, পর্যটন মোটেল, শিশু পরিবার, মসজিদ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্মৃতি ভাস্কর্য রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে বেশিরভাগ কাজ সম্পন্ন হলেও তা জনবলের অভাবে অরক্ষিত। ফলে দর্শনার্থীদের জন্যও খুলে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে নির্মাণ করা মূল্যবান স্থাপনা বছরের পর বছর অযন্তে অবহেলায় বিনষ্ট হচ্ছে। মন্ত্রী ও সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতিশ্রুতির বেড়াজালে আটকে রয়েছে নির্মাণ কাজ।

মুজিবনগর স্মৃতিকেন্দ্রে নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মধ্যে আরও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্তদের আবক্ষ মূর্তি কক্ষ, মিলনায়তন, প্রশাসনিক ভবন। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংবলিত আরও কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। মানচিত্রের বাইরে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ম্যুরাল, ২৫ মার্চের কালরাত্রির চিত্র, পাকবাহিনীর নারী নির্যাতনের চিত্র, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান, ১২ আনসার কর্তৃক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান ও সেক্টর বন্টনসহ জেনারেল অরোরা-নিয়াজি এবং একে খন্দকারের উপস্থিতিতে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য সংবলিত ভাস্কর্য। সব মিলিয়ে মুজিবনগর দর্শনার্থীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হচ্ছে। প্রতি বছর হাজার হাজার দর্শনার্থী এখানে বেড়াতে আসেন। কিন্তু এসব বিষয়ে দর্শনার্থীদের তথ্য দেয়ার মতো লোকবল না থাকায় হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন দর্শনার্থীরা।

গত ১১ এপ্রিল মুজিবনগর কমপ্লেক্সে বেড়াতে আসা বগুড়ার সারিয়াকান্দির মাদরাসা ছাত্র শামীম হোসাইন ও সাথী আক্তার বলেন, স্বাধীনতার ইতিহাসের টানে এখানে ছুটে এসেছি। কিন্তু অনুকূল পরিবেশ না থাকায় বিপাকে পড়েছি। বিশেষ করে পানি ও টয়লেট ব্যবস্থা অপ্রতুল। এতে মেয়েদের নিয়ে সমস্যা বেশি। তাছাড়াও ইতিহাসের অনেক কিছুই দেখছি। তবে এগুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়ার মানুষ পেলাম না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে মুজিবনগরকে সরকারের বিশেষ নজর দেয়ার দাবি জানালেন দর্শনার্থীরা।

এদিকে প্রতি বছর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস পালিত হচ্ছে। মুজিবনগর কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করা হলেও জাতীয় দিবস হিসেবে এখনো স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।

মুজিবনগর প্রেসক্লাব সভাপতি মুন্সি ওমর ফারুক প্রিন্স বলেন, ১৭ এপ্রিল সরকারের শপথের দিনটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। অথচ জাতীয়ভাবে পালিত হয় না মুজিবনগর দিবস। স্বাধীনতার ইতিহাস সমুন্নত রাখতে জাতীয় দিবস ঘোষণার দাবি জানান তিনি। তবে মুজিবনগর কমপ্লেক্সের গুরুত্ব তুলে ধরে এর রক্ষনাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল ও আরো কিছু স্থাপনা নির্মাণের দাবি জানালেন জেলা প্রশাসক।

মেহেরপুর জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ বলেন, সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি দল কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেছে। শিশু পার্ক, লেক ও নতুন কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা নির্মাণেরও আগ্রহের কথা জানান ওই দলের কর্মকর্তারা।