‘বাড়ি আসিস’ বলা শিক্ষক শুধু বিদ্যালয়ের নয় জাতির জন্য ভয়ঙ্কর

 

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর এখতিয়ার নিয়ে মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত নীতিমালা কতোটুকু ত্রুটিমুক্ত? সঙ্গত প্রশ্নের জবাব নিয়ে বিতর্ক হতে পারে বিস্তর। তবে জারিকৃত নীতিমালায় শিক্ষকের নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগ না দেয়ার বিষয়টি খুবই যুক্তিযুক্ত। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশনা প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষকদের প্রায় সকলেই প্রকাশ্যে থোড়ায় কেয়ার করেন। তারপরও প্রশাসনিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এ কারণেই ঘুরে ফিরে প্রাইভেট না পড়ার কারণে শিক্ষার্থীকে নির্মম নির্যাতন করার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। চুয়াডাঙ্গার এমএ বারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের পর এবার অভিযোগ উঠেছে চুয়াডাঙ্গা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এরপরও কি নীরব দর্শক হয়ে থাকবে প্রশাসন? যতো নীরবতা-উদাসীনতা, ততোই ক্ষতি জাতির।

এক সময় মাস্টার মশাইয়ের বেত্রাঘাতকে আর্শিবাদ হিসেবে ধরা হতো। শিক্ষক শুধু বেত্রাঘাতে শাসনই করতেন না, আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ নিতেন। শিক্ষক শিক্ষকতাই করতেন। তিনি শিক্ষকতাকে চাকরি যেমন ভাবতেন না, তেমনই শিক্ষা দিয়ে অর্থ নিতে হবে এরকম ভাবনাটাও ছিলো মাস্টার মশাইদের কাছে অবান্তর। অভিভাবকরাও শিক্ষকের প্রতি রাখতেন অগাধ আস্থা, বিশ্বাস। সময়ের স্রোতে বদলে গেছে অনেক কিছুই। শিক্ষক হতে হলে মেধার বদলে উৎকোচ উপঢৌকনই যখন হয়ে দাঁড়িয়েছে যোগ্যতা তখন শিক্ষক কি আর শিক্ষক থাকেন? তিনিও হয়ে যান অর্থ বিনিয়োগকারী বাণিজ্যিক। শিক্ষকতার বদলে শিক্ষকতাকে চাকরি হিসেবেই শুধু দেখা হচ্ছে না, অনেকেই টাকা দিয়ে চাকরি নিয়ে টাকা তোলার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে জাতির সর্বনাশ ডেকে আনছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই সর্বনাশ ঠেকাতে নীতিমালা প্রণয়ন করে একজন শিক্ষক কতোজন কোন ছাত্র-ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন তার নির্দেশনা দিয়েছে। নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও কথাও বলা হয়েছে। এরপরও যে বিদ্যালয়ের শিক্ষক সেই বিদ্যালয়েরই ছাত্র-ছাত্রীকে প্রকাশ্যেই বাড়ির বরান্দায় বা অন্য কোথাও কোচিং খুলে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন বাণিজ্য। শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে না গেলে, শিক্ষকের নির্দেশনামতে গাইড না কিনলে বিদ্যালয়েই যেনতেন অজুহাত খাড়া করে বেত্রাঘাতে দেগে দেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীর শরীর। অভিভাবকদের কেউ কেউ নালিশ করলেও অধিকাংশেই সে পথ না মাড়িয়ে শিক্ষার্থীকেই দোষারোপ করে তার মানসপটে এঁকে দেন অমানবিকতার ছাপ। তাছাড়া শিক্ষাগ্রহণের পরিবেশ যতোটা সাবলীল ও আনন্দময় রাখা যায় ততোই ভালো। বিজ্ঞান যুগে বিষয়টি নানাভাবে পরীক্ষিত বলেই বেত্রাঘাত দূরের কথা বেত নিয়ে শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষেই প্রবেশ করা বারণ। এরপরও গাছের ডাল দিয়ে মেরে শিক্ষার্থীকে আহত করা শিক্ষককে কি সুস্থ বলা যায়? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর শিক্ষাগ্রহণে মনোনীবেশ করার বদলে ‘বাড়ি আসিস’ বলা শিক্ষক শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই নয়, জাতির ক্ষতিকারক, কলঙ্কের। অর্থলিপ্সু ভয়ানক শিক্ষককে কি মুখে বলে সুধরানো যায়?

একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন মানেই শিক্ষক দোষী নন যেমন, তেমনই শিক্ষা যেহেতুই জাতির মেরুদণ্ড সেহেতু তা খাড়া করে রাখতে কোনো প্রকারের অবহেলা উদাসীনতাও কাম্য নয়। আজকের শিশুই জাতির ভবিষ্যত। আজকের শিক্ষার্থীরাই ধরবে জাতির হাল। তাহলে বর্তমান বিনির্মাণ কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোদ্ধাদের নিশ্চয় নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। শিক্ষকদের তা মনে করিয়ে দেয়াই বাহুল্য। কেননা শিক্ষকরা বর্তমান বিনির্মাণের মাধ্যমে জাতির সামনে সুন্দর ভবিষ্যত হাজির করার কারিগর। যদিও শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে ত্রুটির কারণে মেধার বদলে উৎকোচ অর্থ উপঢৌকনই ঘুরে ফিরে প্রাধান্য পাচ্ছে বলেই শিক্ষার মানও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। শিক্ষকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হচ্ছে শিক্ষার্থীর যৌনহয়রানির অভিযোগসহ কটূকৌশলে শিশুশিক্ষার্থীদের নির্মম নির্যাতনের মতো ঘটনা। দরকার তদন্ত করে দোষীর দ্রুত উপযুক্ত শিক্ষা নিশ্চিত করা।