বাওড় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়াকে গুলি করে খুন : দুজন গ্রেফতার

চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার কায়েতপাড়ায় ভোররাতে বাড়ির অদূরে অস্ত্রধারীদের ওঁত পেতে অবস্থান : সুযোগ বুঝে নৃশংসতা

 

স্টাফ রিপোর্টার/জামজামি প্রতিনিধি: আলমডাঙ্গার পল্লি কায়েতপাড়া বাওড় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়াকে বাওড়ের পাশে বাড়ির অদূরে গুলি করে খুন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার ভোর রাতে বাওড় থেকে ফেরার সময় তাকে একদল অস্ত্রধারী খুব নিকট থেকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে নিবিঘ্নে পালিয়ে যায়। অপরদিকে জিয়াকে তার বাড়ির ঘাটে নামিয়ে ওপারে যাওয়ার সময় নৈশপ্রহরীসহ দুজন সহকর্মী আতঙ্কে নৌকা থেকে লাফিয়ে পানিতে পড়ে চিৎকার শুরু করে।

অস্ত্রধারীদের গুলিতে নিহত জিয়াউর রহমান জিয়া (৩৮) কায়েতপাড়া গ্রামের মাঝেরপাড়ার মৃত আবুল হোসেনের ছোট ছেলে। তিনি মালয়েশিয়ায় প্রবাসী জীবনযাপন শেষে বাড়ি ফিরে গ্রাম সংলগ্ন বিশাল বাওড়ের মৎস্যজীবী সমিতি অন্তভুক্ত হয়ে কয়েক দফা সভাপতি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। বর্তমান কমটির মেয়াদ বাকি ছিলো আরো ৯ মাস। এরই মাঝে তার নিকট মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করা হয়। দরকশাকশির এক পর্যায়ে ১৮ এপ্রিলের মধ্যে চাঁদা দেয়ার  চূড়ান্ত দিনক্ষণ বেধে দেয়ার রাতেই খুন করা হেছে বলে পরিবারের সদস্যসূত্র জানিয়েছে। তবে পুলিশ বলেছে, বাওড়ের আভ্যন্তরিণ বিরোধের জের ধরেই এ খুনের ঘটনা ঘটেছে। ইতোমধ্যেই বাওড় মৎস্যজীবী সমিতির সদস্য সেলিম হোসনে ও ফতেপুরের রবিউল ইসলাম নামের দুজনকে গ্রেফাতর করা হয়েছে। সেলিম কায়েতপাড়া গ্রামের ফজলুর সরদারে ছেলে। আর রবিউল ইসলাম হরিণাকুণ্ডুর দৌলতপুর ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামের মঙ্গল আলীর ছেলে। দুজনকে গ্রেফতারের পর আলমডাঙ্গা থানায় নিয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে। তবে এরা তেমন কোনো তথ্য দিয়েছে কি-না তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি। রাতে এলাকার সেলফোন ট্রাকিঙের পাশাপাশি এলাকার লাইসেন্নধারী বন্দুকের গুলির হিসেবও নিতে পারে পুলিশ। খুব নিকট থেকে জিয়ার মাথায় গুলি করার কারণে তার মাথা ক্ষতবিক্ষত হয়। মাজাতেও লাগে আরও একটি গুলি। অনেকেরই ধারণা, মাথার গুলিটি ঠেকিয়ে করার কারণে একদিক থেকে ঢুকে অপরদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। গতকালই মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ নিজ গ্রামে নেয়া হয়। সন্ধ্যার পর দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। গ্রামে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলার অলমডাঙ্গা উপজেলার খাসকররা ইউনিয়নের কায়েতপাড়া গ্রাম সংলগ্ন বিশাল বাওড়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে ঝিনাইদহের ফতেরপুর ও পার্বতীপুর। উত্তর-পূর্ব প্রান্তে নরায়ণকান্দী ও পোলতাডাঙ্গা। পশ্চিমের তীর ঘেঁষে কায়েতপাড়া, রামদিয়া। এসব গ্রামের ২৬৭ জন বওড় মৎস্যজীবী সমিতির সদস্য। ভোটের মাধ্যমেই নেতা নির্বাচিত হন। সভাপতি হিসেবে পর পর দু’দফা নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমান জিয়া। সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন নারায়ণকান্দীর নজির আলী।

জিয়াউর রহমানের স্ত্রী ফিরোজা খাতুন বলেছেন, মাঝে মাঝেই সন্ধ্যার পর বাওড়ে যেতেন। গতপরশু সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়ে বাওড়ে যান। বাওড়ের নৈশ প্রহরীসহ সাথে থাকা কয়েকজন বলেন, রাতে নৌকার ওপরই এশার নামাজ আদায় করেন। সারা রাত বওড়ে থাকার পর শেষ রাতের দিকে যখন আকাশে মেঘ গুড় গুড় করতে শুরু করে। তখন জিয়াউর রহমান জিয়া নৈশ প্রহরীসহ সাথে থাকা লোকজনকে তার বাড়ির ঘাটে নৌকা নিতে বলেন। তাকে নামিয়ে নৌকা ওপারের দিকে নিতেই গুলির শব্দে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েন। বাড়ির লোকজনের ঘুম ভাঙে। তখন আনুমানকি রাত ৩টা। ভোরেই খবর দেয়া হয় পুলিশে। সকালে আলমডাঙ্গা থানার ওসি আকরাম হোসেন সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর ও আলমডাঙ্গা সার্কেল) তরিকুর ইসলামসহ অনেকে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, একজন সাধারণ নিরিহ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হন, আমরা সেদিকে বিশেষ নজর রাখছি। ইতোমধ্যেই হত্যাকাণ্ডের কারণসহ খুনিদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যেই গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়েছে। নিহত জিয়াউর রহমানের ভাই শরিফুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন।

স্থানীয়সূত্র বলেছে, কয়েক মাস ধরেই জিয়াউর রহমান জিয়ার কাছে ৬ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিলো একটি চক্র। প্রথমে ওই চক্রকে তেমন পাত্তা না দিলে জিয়ার বাড়ির পাশে এসে গুলি ছুড়ে অস্ত্রধারী চাঁদাবাজচক্র জানান দিয়ে যায়। পরবর্তীতে বাওড়ের পাশে কয়েকটি বোমাও বিস্ফোরণ ঘটায় অস্ত্রধারীরা। এরপর চাঁদার টাকার পরিবমাণ কমানোর  জন্য দরকশাকশি চলতে থাকে। জিয়ার তরফে তিন লাখ টাকা দেয়ার কথা জানানো হলেও চরমপন্থি পরিচয়ে চাঁদা দাবি করা অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তিরা ৫ লাখ টাকা নিয়েই ছাড়বে বলে জানায়। এক পর্যায়ে তারা চূড়ান্ত দিনক্ষণ বেঁধে দেয়। গতকাল ভোরে গুলি করে খুনের পর চরমপন্থি পরিচয়ে দাবিকরা চাঁদাবাজদেরই যেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে রাখতে শুরু করে স্থানীরা তেমনই গতপরশু মঙ্গলবার বাওড়ে পোনা দেয়া নিয়ে রামদিয়ার বাজারে এলাকার আলোচিত ওল্টুর ভাই লাঠুর সাথে জিয়ার বাগবিতণ্ডা হয়। লাঠু দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। সেই হুমকির বিষয়টিও গতকাল স্থানীয়দের মধ্যে আলোচনায় উঠে আসে। এছাড়া জিয়াউর রহমান জিয়া গত ইউপি নির্বাচনে বর্তমান চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান রুন্নুর পক্ষে কাজ করেন। সে হিসেবে আওয়ামী লীগের অপর নেতা সাবেক চেয়ারম্যান তাফসির আহমেদ মল্লিক লালের বিরাগভাজন ছিলেন বলেও অনেকের অভিমত। এ বিষয়টি স্থানীয় একটি পক্ষ গুরুত্ব দিলেও গোয়েন্দা পুলিশের নজর অবশ্য বাওড়ের কর্তৃত্ব নিয়ে দীর্ঘদিনের ঠাণ্ডা লড়াইয়ের দিকেই।

আলমডাঙ্গা কায়েতপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি হাফিজুর রহমান নিহত জিয়াউর রহমানের মৃত্যুতে বিদ্যালয় একদিনে ছুটি ঘোষণা করেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুতে তার স্ত্রী ফিরোজা বেগম, বড় মেয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী মেরিনা খাতুন, তৃতীয় শেণীর ছাত্র জিহাদ হোসেন এবং ৬ মাস বয়সী কন্যা ফাতেমার ভবিষ্যত নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণকান্দী-কায়েতপাড়া বিলে প্রায় ৩০০ একর জলকর আছে। যার মধ্যে ২৬৭ একর সরকারের। এই সমিতির সদস্য সংখ্যা ২৬৭ জন। নারায়ণকান্দী ও কায়েতপাড়া গ্রামের মানুষ এখানকার সদস্য। সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজির আলীর বাড়ি বিলের পূর্বদিক ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার নারায়ণকান্দী গ্রামে।

গ্রামের লোকজন জানায়, নজির আলী সকালের দিকে একনজর লাশ দেখতে আসলেও কয়েক মিনিট পর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি।