প্রতিবন্ধী সন্তান জন্মের অপরাধে মমতাজ এখন ঘরছাড়া

মাজেদুল হক মানিক: শ্বশুর-শাশুড়ির আমাকে বলতেন ‘তুই অপয়া। পোকাড়ে বেগুন জন্ম দিয়েছিস। এর দায়ভার তোকেই নিতে হবে। ওর চিকিৎসা করে আর কি হবে। উঠতে বসতে নানা নির্যাতন সইতে হয়েছে। স্বামী বিদেশে গিয়ে বাবা মায়ের কথা গুনে আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। গরিব পিতার বাড়িতে খেয়ে না খেয়ে কোনমতে বেঁচে আছি। এভাবেই নিজের দুর্বিসহ জীবনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন মেহেরপুর গাংনী উপজেলার কাজিপুর গ্রামের গৃহবধু মমতাজ বেগম। প্রতিবন্ধী শিশু পুত্র জন্ম দেয়ার অপরাধে শ্বশুর-শাশুড়ির নির্যাতনের শিকার মমতাজ এখন বড় অসহায়। দাম্পত্য জীবনের নানা নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। মমতাজ বলেন, আয়-রোজগার নেই। ছেলের চিকিৎসা করতে পারছি না। প্রতিদিন ছেলের জন্য ওষুধ ও ভালো খাবার লাগে। একমাত্র বুকের ধন না খেয়ে বিনা চিৎসায় মরতে বসেছে। বর্তমানে তিনি পিতার বাড়ি একই উপজেলার বেতবাড়িয়া গ্রামে অবস্থান করছেন। নির্যাতনের মামলায় গ্রেফতার করে তার শ্বশুর-শাশুড়িকে আদালতে সোপর্দ করেছে গাংনী থানা পুলিশ। তারা দুজনে বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন। মামলা তুলে নিতে মমতাজকে হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তার পরিবারের।

জানা গেছে, কাজিপুর গ্রামের মকবুল হোসেনের ছেলে সেলিম রেজার সাথে নয় বছর আগে বিয়ে হয়। সেলিম তার আপন খালাতো ভাই। তখন সে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলো। মমতাজের সাথে তার বিয়ে না হলে বিষপানে আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দিয়েছিলো। মমতাজের পিতামাতার আপত্তি সত্ত্বেও বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিন দাম্পত্য ভালো কেটেছে। ২০১০ সালে তার পঙ্গু ছেলে সাবিদের জন্ম হয়। এখন তার বয়স সাত বছর। হাঁটাচলা করতে পারে না। মায়ের কোলে বসেই তার আহারসহ যাবতীয় কার্যাদি চলে। মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয়। উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না। সাবিদের জন্মের পর থেকেই মমতাজের দাম্পত্য জীবনের সুখে ছেদ পড়ে। স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির কটু কথা শুনতে হয়। সাবিদের এই অবস্থার জন্য তার মমতাজকে দায়ী করে। এভাবেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্যেই দাম্পত্য জীবনের সময় পার হতে থাকে। সাত মাস আগে তার স্বামী সেলিম রেজা উমানে পাড়ি জমায়। বিদেশ যাওয়ার জন্য মমতাজের পিতা ঋণ করে দেড় লাখ টাকাও দেন জামাইকে। মেয়ের সুখের জন্য তিনি ধার-দেনা করতে পিছপা হননি। কিন্তু সুখের বদলে তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের অমানিষা। মমতাজ বেগম জানান, স্বামী বিদেশ যাওয়ার পর থেকে তার সাথে যোগাযোগ করেনি। পিতামাতার সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়। কিন্তু ছেলে ও স্ত্রীর খোঁজ নেয়না সেলিম রেজা। স্বামীর বাড়িতে অসহায় জীবন-যাপন করার এক পর্যায়ে সম্প্রতি গাংনী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন গৃহবধু। গত ২১ এপ্রিল রাতে গাংনী থানা পুলিশ মমতাজের শ্বশুর মকবুল হোসেন ও শাশুড়ি স্বাধীনা খাতুনকে গ্রেফতার করে আদালদে সোপর্দ করে। তার পর থেকেই শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ মমতাজের।

মমতাজের মা মদিনা খাতুন, তার স্বামী দিনমজুর কৃষক। পাশাপাশি বাড়ির সঙ্গে একটি চায়ের দোকান রয়েছে। একমাত্র ছেলে মাসুদ রানা কয়েক মাস আগে ধারদেনা করে উমানে গেছে। কিন্তু আয় রোজগার তেমন নেই। বাড়িতে কোন টাকা পাঠাতে পারে না। বড় মেয়ে বিবাহিত। চায়ের দোকান ও দিনমজুরির আয় দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। মেয়ের দুর্বিষহ সংসার জীবনের বর্ণনা দিয়ে মদিনা খাতুন বলেন, মমতাজের ছেলের ওষুধ ও খাওয়ার জন্য প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকার দরকার হচ্ছে। এই টাকা তাদের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই অসহায় এই পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সমাজের সহৃদয়বান ব্যক্তিদের সহযোগিতা চাইলেন তিনি। মদিনার খালাতো ভাই আব্দুল মাতিন বলেন, মামলা করে মমতাজের জীবন এখন হুমকির মুখে। আসামিপক্ষের লোকজন দেখে নেয়ার হুমকি অব্যাহত রেখেছে। তাই আমরা সবাই ভীত হয়ে পড়েছি। মমতাজের মানবেতর জীবনের কথা শুনে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন গাংনী ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম জামাল আহম্মেদ। তিনি বলেন, প্রত্যেকটি বিবেকবান মানুষেরই উচিত মমতাজের পাশে দাঁড়ানো। গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, মমতাজকে যারা হুমকি দিচ্ছে তাদের বিষয়ে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। মেহেরপুর জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ বলেন, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।