মাধ্যমিকে পাসের হারে হতাশা : মূল্যায়ন মাফকাঠি নিয়ে প্রশ্ন

সম্পাদকীয়

‘গেলো বছর বন্যা হলো, এ বছরে খরা’ সেই গানের মতোই যেন দেশে এসএসসি পরীক্ষার মূল্যায়নের দশা। গত কয়েক বছর ধরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকসহ নিম্নমাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে যা শুরু হয়েছে তা দেশের শিক্ষার্থীদের গিনিপিগের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে বললে কি খুব ভুল বলা হয়? কয়েক বছর ধরে ঢালাও পাস, যেন পরীক্ষা দিলেই পাস করা যায়। এরপর এবার তাতে নাকি টান দেয়া হয়েছে। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়নের কারণে ফলাফল এরকম হয়েছে। এই নতুন পদ্ধতিটা কী?
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয় গতপরশু বৃহস্পতিবার। যে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে, তা দেখে কিছু প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক। তারপর যখন চুয়াডাঙ্গা যশোর শিক্ষাবোর্ডের মধ্যে নবম হয় তখন তো জেলার শিক্ষার গতি প্রকৃতি নিয়ে শুধু প্রশ্নই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার নামে তা হলে কী করা হয় সেটা দেখারও তাগিদ উঠে এসেছে। সারা দেশে ফল বিপর্যয়। সেই বিপর্যয়ের তলানিতে চুয়াডাঙ্গা জেলা। যশোর শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার যখন ৮০ দশমিক শূন্য ৪ তখন চুয়াডাঙ্গায় পাসের হার ৭৩ দশমিক ২১। কেন? চুয়াডাঙ্গা জেলার সকল পরীক্ষার্থীর খাতাই নিশ্চয় শুধু কড়া পরীক্ষকের নিকটে পড়েনি? মূল্যায়নে মেজাজ ভেদে কিছুটা তারতম্য হলেও গড় পাসের হারে যখন বড় ফারাক পরিলক্ষিত হয় তখন হতাশা বাড়ে বৈ কমে না। চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরের ফলাফল হতাশাজনক। অবশ্যই কারণ অনুসন্ধান করে এখনই দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় পিছিয়ে পড়া জেলা দুটির প্রজন্মও পেছনের সারিতেই থেকে যাবে। ওদের এগিয়ে দিতে না পারলে এলাকা এগোবে না। কেনোনা, শিক্ষার মাধ্যমেই এলাকার অগ্রযাত্রা তরান্বিত হয়। যদিও শিক্ষার মানবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বহুদিন ধরেই শিক্ষক নিয়োগে চরম অনিয়মটাই বড় কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। টাকা দিয়ে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তি শুধু বেতনের জন্য চাকরিই করেন না, তিনি প্রাইভেট ও কোচিং করানোতেই আগ্রহী হন। তার কাছ থেকে শিক্ষকতা প্রত্যাশা আহাম্মুখিও বটে।
এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ প্রাপ্তির সংখ্যা কম হওয়ার জন্য হয়তো, কোনো কোনো শিক্ষক বলবেন, উত্তরপত্র মূল্যায়নে এবার এক দু নম্বরও অনুকম্পা দেখানো হয়নি। আগে কোনো বিষয়ে ৭৭ পেলেও তাকে ৮০ দিয়ে গ্রেড পয়েন্ট প্লাস করা হতো, এবার নাকি সেটা করা হয়নি। তাছাড়া পাসের বেলায়ও ৩৩ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ অনুকম্পার অলিখিত নিদের্শনা ছিলো বলে শোনা যায়। সঙ্গত প্রশ্ন- তখন থাকলো এখন থাকলো না কেন? তাছাড়া শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল করতে লেখাপড়ায় সৃজনশীল পদ্ধতি যুক্ত করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকল বিষয়ে সৃজনশীল করা হলেও সকল বিদ্যালয়ের সকল বিষয়ের সকল শিক্ষককে কি সৃজনশীল পাঠদানে পারদর্শী করা হয়েছে? তা হলে খাতা মূল্যায়নে হঠাত করে এরকম বদলানো কেন? জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়? নাকি পাসের হার কারো চোখের শূল হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো। অবশ্যই পরীক্ষা শিক্ষা যাচাইয়ের মাফকাঠি। তাই বলে কখনো কখনো সেই মাফকাঠিকে রবারের মতো ইচ্ছে মতো লম্বা বা খাটো করা মানে পরীক্ষার্থীদের নিয়ে তামাশা করা নয়কি? আর যাই হোক শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দেয়ার অধিকার নীতি নির্ধারকদের নেই। কমলমতি শিক্ষার্থীদের মানসপটে বিভ্রান্তির ছবি জাতির ভবিষ্যতের ওপরও প্রভাব ফেলে। ফলে এ সিদ্ধান্তে খামখেয়ালি চলে না।
অবশ্যই পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়েও পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। সেটা গবেষণার জন্য শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ ভাবলে বড্ড ভুল হয়। সে কারণেই পদ্ধতি প্রণেতাদের অবশ্যই দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হয়। তাই বলে বিশ্বমানের শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি প্রণয়নে মেতে ওঠে দেশের বাস্তবতাকে ভুলে গেলে পদক্ষেপ ভুলের শঙ্কাই বেশি থাকে। এদিকে যেমন বিশেষ যতœবান হওয়া দরকার, তেমনই চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরে পাসের হার কেন এতো পিছিয়ে তাও খতিয়ে দেখে যতো দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। কালবিলম্বে বাড়বে ক্ষতি।
এতোকিছুর মধ্যেও যারা উত্তীর্ণ হয়েছো, যারা এ প্লাস পেয়েছো তাদের সকলকে দৈনিক মাথাভাঙ্গার অভিনন্দন। যারা কৃতকার্য হতে পারোনি তাদের পাশেও আমরা। মনে রেখো, ব্যার্থতা সফলতারই শোপান।