চুয়াডাঙ্গার কালুপোল রাজারভিটার পর দামুড়হুদা চারুলিয়ায় চাঞ্চল্য

 

মাটির নিচে লুকায়িত প্রাচীন স্থাপত্য : প্রত্নত্ত্বতের সন্ধ্যান

নজরুল ইসলাম/শরিফ রতন: চুয়াডাঙ্গা জেলায় অদ্যবদি প্রত্নত্ত্বতের নিদর্শণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও সম্প্রতি কালুপোলের পর দামুড়হুদার চারুলিয়া গ্রামের মেহমান শাহ (র:) মাজার সংলগ্ন দক্ষিণ পার্শ্বে মাটির নিচে লুকায়িত পূরার্কির্তীর নিদর্শণ ভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছে প্রত্নত্ত্ব অধিদপ্ত। প্রতœত্ববিদরা জোরেসোরে শুরু কছে প্রাথমিক খনননের কাজ। কৌতূহলি হয়ে উঠচ্ছে এলাকার মানুষ। স্থানটিকে সংরক্ষিত পূরার্কির্তী ঘোষণা করতে পারলেই পরবর্তীতে মূলখননের কাজ শুরু হবে। প্রত্নত্ত্বতের উপকরণ আবিষ্কার হলে চুয়াডাঙ্গা জেলার ইতিহাস হবে সমৃদ্ধ। গড়ে ওঠার দার উন্মোচিত হবে পর্যটন কেন্দ্র এবং জাদুঘরের মতো স্থাপনা।

ইতিহাস বিশ্লেষণ করে জানা যায়, চর্তুদশ শতকে সেনযুগে বাংলার ভাস্কর্য শিল্পের চরম উন্নতি ঘটে। বাংলার ভাস্কর্যের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও স্বতন্ত্র ধারাও এ যুগে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুলতানি শাসনামল শুরু হয়  তের শতকের সূচনালগ্নে (১২০৪-০৫)। ইতিহাসে সুলতানি আমলের স্থায়িত্ব ছিলো ১১৮৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। প্রায় ৩ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে টিকে থাকা এ সুলতানি আমল ইতিহাসের অনেক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করে। ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ এর মধ্যে চলা বাংলার সুলতানি আমল বেশ সমৃদ্ধশালি ছিলো। তখন থেকেই বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। তবে এর অনেক আগে থেকেই বাংলার সাথে আরব মুসলমানদের যোগাযোগ ছিলো। অবশ্য সে যোগাযোগের স্বরূপ ছিলো বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় এবং তা উপকূলীয় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিলো।

তৎকালীন দক্ষিণ বঙ্গের ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে আর্বিভাব হন হযরত খানজাহান আলী (র.) ছিলেন একজন মুসলিম ধর্ম প্রচারক এবং বাংলাদেশের বাগেরহাটের স্থানীয় শাসক। তিনি কোরআন, হাদিস, সুন্নাহ ও ফিকহ শাস্ত্রের উপর গভীর জ্ঞানার্জন করেন। খানজাহান আলী ১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সেনা বাহিনীতে সেনাপতির পদে কর্ম জীবন আরম্ভ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধান সেনাপতি পদে উন্নিত হন। ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে খানজাহান আলী প্রায় ১ লক্ষ সৈন্য নিয়ে বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার আরম্ভ করেন। ধারণা করা হচ্ছে ভৈরব নদী পথে তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদহ ইউনিয়নের চারুলিয়া গ্রামে অবস্থান নেন। সাথে বহু সৈন্য থাকায় তাদের খাবার, গোসল এবং ওযু করার জন্য একটি পুকুর খনন করে পানির বন্দবস্ত করেন। আর থাকার জন্য মাটি দিয়ে তৈরি ইটের প্রাসাদ, নামাজের জন্য মক্ত এবং বৈঠক থানা তৈরি করেন। পরবর্তীতে ভৈরব নদি হয়ে খুলনা অভিমুখে রওনা হওয়ার সময় এ সমস্থ স্থাপনা দেখভালো এবং ইসলাম প্রচারের জন্য একজন অনুসারি রেখেযান। আর তিনিই হচ্ছেন হযরত সৈয়দ জহিরুউদ্দীন ওরফে মেহমান শাহ (র:)। আর এসব ঘটেছে সুলতানী আমলে। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কালুপোল রাজার ভিটায় যে সমস্থ নিদর্শন পাওয়া গেছে ঠিক তেমনি একই ধরণের নিদর্শন এখানেও রয়েছে। প্রত্নত্ত্বঢিবির চারপাশে বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়ে থাকা সাংস্কৃতিক জঞ্জাল, পাতলা টালি ইটের ভগ্নাংশ, কারুকার্য খোচিত ইট, চুন সুরকির নমুনা থেকে অনুমান করা যায় ঢিবির নিচে সুলতানী আমলের প্রাচীন স্থাপত্যা নিদর্শন লুকায়িত আছে।

জনশ্রুতি আছে, চারুলিয়া গ্রামের নাম করণ হয়েছে চার আউলিয়া থেকে। প্রথম দিকে গ্রামের নাম ছিলো চাহার (চার) আউলিয়া, পরবর্তীতে চার আউলিয়া এবং সবশেষ চারুলিয়া। যা বর্তমানে চারুলিয়া নামেই বিদ্যমান। হযরত খানজাহান আলী (র.) অনেক অনুসারি থাকলেও তাদের মধ্যে চুয়াডাঙ্গার গড়াইটুপির মও.আলী মালিক-উল-গাউছ, দামুড়হুদা চারুলিয়ার মেহমান শাহ, মেহেরপুরের মেহেরুল্লাহ শাহ, মুজিবনগর বাগোয়ানের ফরিদুল্লাহ শাহ অন্যমত। চারুলিয়াসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর ইসলামিক নাম করণ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় গ্রামটি ১৫শ শতক থেকেই মুসলিম অধ্যুষিত ছিলো। চারুলিয়া গ্রামের পাঠানপাড়ার নারী ও পুরুষের নৃতাত্তিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এশিয়ার নৃ-জনগোষ্ঠীর সুস্পষ্ট ছাপ পরিলক্ষিত হয়। গ্রামের প্রবীন ব্যাক্তিরা জানান, তাদের পূর্বপুরুষেরা ১৪১৯ খ্রি: থেকেই এ গ্রামে বসবাস করছে। হযরত মেহমান শাহা’র মাজার প্রাঙ্গণে ৮টি দুর্লভ প্রজাতির অজ্ঞাত নামা পুরাতন গাছ রয়েছে। গাছগুলোকে এলাকার লোকজন তসবীগাছ বলে থাকেন। অনেকেই গাছগুলোকে ৩-৪শ বছরের পুরাতন বলে দাবি করেছেন। কেউ কেউ আবার গাছগুলোকে হযরত মেহমান শাহ (র:) সমসাময়িক কালের বলেও মনে করেন। এ গাছের ফল থেকে তজবী দানা তৈরি করা যায়। এটি ভৈবর নদীর পশ্চিম তীরবর্তী গ্রাম হওয়ায় এটি একটি প্রাচীন গ্রাম বলেই মনে করা হচ্ছে। এখানে একটি প্রাচীন পুকুর আছে। এর দক্ষিণে মাটির নিচে যেখানে খননকরা হচ্ছে রয়েছে সুলতানী আমলের ইমারতের নমুনা। উত্তরে মেহমান শাহর মাজার, পূর্বে ভৈবরব নদী এবং দক্ষিণে বোয়ালমারি গ্রাম। যে ইট দিয়ে প্রাসাদ নির্মান করা হয়েছে একই ইট দিয়ে মেহমান শাহ’র মাজার এবং মাজারের ঘর তৈরি করা হয়েছে। যা ইত:পূর্বে চুয়াডাঙ্গা সদরের কালুপোল রাজার ভিটায় পাওয়া গেছে।

প্রত্নত্ত্বাতিক অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কাস্টোডিয়ান গোলাম ফেরদৌস বললেন, কালুপোলের রাজার ভিটার নিদর্শনের পর মেহমান শাহ’র আস্তানার নিদর্শণের হুবহুব মিল রয়েছে। তবে কালুপোলের চাইতে এখানে অনেক জায়গা জুড়ে স্থাপত্য আছে। যেখানে খনন করা হেচ্ছ বর্তমানে জায়গাটি গ্রামের রেজাউল শেখের ছেলে আলিমদ্দীন গঙের নামে ২ একর জমি রেকর্ডভূক্তো আছে। তবে স্থানটিকে সংরক্ষিত পূরার্কির্তী ঘোষণা করতে পারলেই পরবর্তীতে মূলখননের কাজ শুরু হবে। প্রত্নত্ব উপকরণ আবিষ্কার হলে চুয়াডাঙ্গা জেলার ইতিহাস হবে সমৃদ্ধ। গড়ে ওঠার দার উন্মোচিত হবে পর্যটন কেন্দ্র এবং জাদুঘরের মতো স্থাপনা। যেটা জেলাবাসীর বিরাট পাওয়া।

প্রফেসর আব্দুল মোহিত বলেন, ১৪১৯ সালে অর্থাৎ আজ থেকে ৫শ ৯৭ বছর আগে খানজাহান আলী ভৈরব নদী পথে দিল্লী থেকে খুলনা বাগেরহাটে আসেন। তিনি বাগেরহাটে পৌছানোর আগে দামুড়হুদার চারুলিয়াতে অবস্থান নিয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কারণ মেহমান শাহ তার ৪ জন অনুসারির মধ্যে একজন অন্যমত। আর তিনি চলে যাওয়ার সময় দায়িত্বটা তাকেই দিয়ে যান এমনটাই মনে হচ্ছে। তবে চুড়ান্ত কিছু করতে স্থানীয় রাজনৈতীক নেতৃবৃন্দের সদিচ্ছা সবার আগে দরকার।

সংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রানালয়ের প্রত্নত্ত্বাতিক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাব হোসেন বলেন, ব্রিটিশরা এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে বাংলাদেশের কোনো কোনো জেলায় প্রত্নত্ব আছে তার জরিপ চালিয়ে ছিলো। সে জরিপ থেকে চুয়াডাঙ্গা জেরার নাম বাদ পড়ে যায়। তাই জেলার কোথায় কোথায় প্রত্নত্ত্ব নিদর্শণ আছে তা নিরুপন করা কষ্ট সাধ্য ছিলো। তার পরও জরিপ করে তিনটি জায়গা নিরুপন করা হয়েছে। প্রথমিক খননের কাজ চলছে। খননের এলাকাগুলো সংরক্ষিত পূরার্কির্তী এলাকা ঘোষনা করা গেলে মূলকাজ শুরু হবে। তবে তা দ্রুত করার চেষ্টা চলছে। আর এটা করতে পারলে চুয়াডাঙ্গা জেলার ইতিহাস যেমন হবে সমৃদ্ধ তেমনি সৃষ্টি হতে পারে অনেক কিছু। এর জন্য চাই সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন আছে।

মাজার কমিটির খাদেম তাহদুল খাঁ বলেন, প্রতিবছর ৫ ই ফালগুণ এখানে ওরশ হয়। পূর্বপুরুষ থেকে মেহমান শাহ’র মাজারের নাম শুনে আসছি তিনি একজন ধর্মপ্রচারখ ছিলো। তাই এ মাজারকে গ্রামবাসী সকলেই সন্মানের চোখে দেখে।

উল্লেখ্য, ইতিহাস সমৃদ্ধ চুয়াডাঙ্গা জেলায় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রত্নত্ত্ব ও ঐতিহাসিক নিদর্শণ আবিষ্কারে জরিপ শুরু হয়। এ জরিপে চুয়াডাঙ্গা জেলার ২২৫টি গ্রামের ৯৪টি জায়গায় অনুসন্ধান চালানো হয়। এর মধ্যে ৩টি স্থানকে চিহ্নিত করা হয়। দামুড়হুদার চারুলিয়া মেহমান শাহ’র মাজার সংলগ্ন ভিটা, জীবননগরের দৌলতগঞ্জ এবং চুয়াডাঙ্গা সদরের কালুপোল গন্ধোপ রায়ের (রাজার ভিটা) প্রসাদ। এরিমধ্যে রাজার ভিটায় ধুপচি, লোহার তৈরি বল্মম, মাটির হাড়ি, সারা, কড়ি, পশুর হাড়, হরিণের শিং, মাটির তৈরি পুতুল, প্রদীপ, সানকিসহ বেশকিছু নিদর্শণ আবিষ্কার হয়েছে। চারুলিয়াতে তেমনি কিছু আবিষ্কারের পথে।