মেহেরপুরে শিলা ও ঝড়-বৃষ্টিতে উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি : নিহত ১ আহত শতাধিক

ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনকালে সহযোগিতার আস্বাশ দিলেন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা চেয়ারম্যান

মেহেরপুর অফিস/মুজিবনগর প্রতিনিধি: মেহেরপুরে কাল বোশেখি ঝড় এবং শিলা-বৃষ্টিতে শ’ শ’ ঘরবাড়ি ও গাছপালা ভেঙে পড়েছে এবং উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন অনেকে। কয়েক হাজার হেক্টর জমির ধান বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ও শিলা-বৃষ্টির কারণে পাটসহ সবজি-জাতীয় ফসলের পাতাবিহীন গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। এছাড়া বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন একবৃদ্ধা এবং ভেঙে যাওয়া গাছপালা ও ঘরবাড়ির উড়ে যাওয়া টিনের আঘাতে আহত হয়েছেন প্রায় শতাধিক মানুষ।

গত ২-৩ দিনের কাল বোশেখি ঝড় এবং শিলা-বৃষ্টি সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে সদর উপজেলার পিরোজপুর ও আমদহ এবং মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান, মোনাখালী, দারিয়াপুর ও মহাজনপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। এতে এলাকার শ’ শ’ কৃষক ও সাধারণ মানুষ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রোববার সকালে মেহেরপুর জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ সদর ও মুজিবনগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর পরিদর্শন করেন। এসময় তার সাথে ছিলেন মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হেমায়েত উদ্দীন ও ইউপি চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেনসহ অনেকে।

মেহেরপুর জেলার প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমির ধান, পাট ও কলাসহ উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যদিও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসেব মতে ক্ষতির পরিমান খুবই কম।

মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান ইউপি চেয়ারম্যান আয়ূব হোসেন জানান, তার ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের মাঠে লাগানো ইরি ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কেটে রাখা ধান পানিতে ভাসছে আর কাটার উপযুক্ত দাঁয়িড়ে থাকা ধান পানির নিচে ডুবে রয়েছে। এসব ধানে কল হয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো মাঠে শিলা-বৃষ্টির কারণে পাট গাছ পাতাবিহীন হয়ে পড়েছে। আবার দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ধান শিলের আঘাতে ঝরে ঝরে পড়েছে। সব মিলিয়ে তার ইউনিয়নের চাষিরা বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকারি সহযোগিতা ছাড়া কৃষকদের ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে বলে তিনি জানান।

মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের মানিক নগর গ্রামের ধানচাষি আব্দুল মোতালেব জানান, তিনি ১০ বিঘা জমিতে ইরি ধান চাষ করেছিলেন। তার অধিকাংশ ধান এখন পানির নিচে। বাগোয়ান গ্রামের রানা ও তার স্বজনদের ১৫ বিঘা জমির কলা ঝড়ের আঘাতে মাঠিতে শুয়ে পড়েছে। মেহেরপুর সদর উপজেলার আমদহ ইউনিয়নের সাহেবপুর গ্রামের মহিউদ্দিন জানান,  পরশু রাতের শিলা-বৃষ্টিতে তার ১০ বিঘা জমির পাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাহেবপুর এলাকার চাষিরা আরও জানান, এলাকার ৭-৮ টি গ্রামের মাঝে রোয়াকোলার বিল। ওই বিলের কয়েক হাজার বিঘা জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এতে চাষিরা এবছর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।

সাহেবপুর গ্রামের আমচাষী ফজলুল হক জানান, তার বাগানে গাছের আম ঝড়ে পড়ে গেছে। তার পরও যেগুলো গাছে রয়েছে তাতেও শিলের আঘাতে দাগ হয়ে যাচ্ছে। পাশ্ববর্তী অনেক চাষির লিচুর বাগানের লিচু গাছ ঝড়ে ভেঙে গেছে। এবছর আম-লিচুর ব্যাপক ক্ষতি বাগান মালিক ও ব্যাবসায়ীদের পথে বসিয়ে যাবে।

মুজিবনগর উপজেলার ৪ ইউনিয়ন ও সদর উপজেলার ২ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের দেয়া তথ্য মতে গত শনিবার রাতের ঝড়ে প্রায় ৪ শতাধিক কাঁচা ঘর-বাড়ি ও স্কুল-কলেজ ভেঙে ও টিন উড়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকার কয়েক শ’ গাছ-গাছালি ভেঙে ও উপড়ে পড়েছে। ঝড়ে মুজিবনগর উপজেলার শিবপুর দারুল কোরান দাখিল মাদরাসার টিন উড়ে গেছে। গতকাল রোববার সকালে মোনাখালী ইউপি চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রতিষ্ঠানটির নামে ১০ হাজার টাকা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন বলে জানান প্রতিষ্ঠানের সুপার আব্দুল ওয়াদুদ।

এদিকে ঝড়ের সময় আম কুড়াতে গিয়ে আলতাফন খাতুন (৬০) নামের এক বৃদ্ধ বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন। শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে মেহেরপুর সদর উপজেলার বুড়িপোতা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া গত দু দিনে জেলার বিভিন্নস্থানে ঘরবাড়ি ও গাছ-পালা ভেঙে পড়ায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। এদের অনেকে হাসপাতালে ও বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছেন। আবার কেউ কেউ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

এদিকে গতকাল রোববার সকালে জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ সরজমিন পরিদর্শন করে গৃহহারা মানুষের আর্থিক সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক এসএম মোস্তাফিজুর রহমান সরকারি কাজে কুষ্টিয়া থাকায় তার প্রতিনিধি খায়রুল ইসলাম জানান, ঝড়-বৃষ্টি ও শিলায় ফসলের ক্ষয়-ক্ষতির হিসেব তাদের কাছে নেই। বোশেখি ঝড়-বৃষ্টি হবে স্বাভাবিক। কিছু ফসলের ক্ষতি হলেও কৃষক তা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

উল্লেখ্য, গত তিন দিন রাত ৯টার দিকে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয় এবং ঘণ্টাব্যাপী ৩ দিনের ওই ঝড়-বৃষ্টি ও শিলার আঘাতে জেলার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পথে বসেছে।

গাংনী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, শনিবার রাতের কাল বোশেখি ঝড়ে মেহেরপুর গাংনীর সাহারবাটি মাঠে ৮টি বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়েছে। ফলে সাহারবাটিসহ আশেপাশের গ্রামগুলো বিদ্যুতবিহীন হয়ে পড়েছে।

পল্লী বিদ্যুতসূত্রে জানা গেছে, শনিবার রাতে কাল বোশেখি ঝড়ের সময় সাহারবাটি মাঠের ১১ কেভি লাইনের ৮টি খুঁটি ভেঙে পড়ে। তার ছিড়ে যায়। এতে খুঁটির মাথায় থাকায় বিভিন্ন সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। খুঁটিগুলো পুনঃস্থাপন করে লাইন ঠিক করা সময় সাপেক্ষ বিষয়। তবে গতকাল থেকেই কাজ শুরু হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব লাইন মেরামত করে লাইন চালু করা হবে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয়সূত্রে জানা গেছে, বোশেখের শুরু থেকেই ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। যা দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এমনটি হয়নি। গত দুই সপ্তাহে চার দিন ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে শনিবারের ঝড় ছিলো শক্তিশালী। ঝড়ের তোড়ে গাংনী কাঁচা বাজারসহ বিভিন্ন গ্রামের ঘরের টিনের ছাউনি উড়ে গেছে। গাছপালা ও বোরো ধানের ব্যাপক্ষ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয়সূত্রে জানা গেছে।