জলবায়ু চুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে বিশ্বব্যাপী হতাশা

 

স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্যারিস জলবায়ু থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার সিদ্ধান্তের পর চীন, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে এই ইস্যুতে এখন নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত হচ্ছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত আমাদের গ্রহকে আবারো শ্রেষ্ঠ করে গড়ে তোলার বার্তা দিয়েছে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেছেন, যেকোনো দেশ তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চুক্তি বাস্তবায়নে কাজ করতে পারবে। এখানে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু ট্রাম্প মার্কিনিদের মিথ্যা বলছেন যে, এই চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বিশাল বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দেন। এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের উপর ‘অর্থনৈতিক বোঝা’ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তাই আরো ‘ন্যায্য’ চুক্তির জন্য তিনি বিশ্ব নেতাদের সাথে আলোচনায় বসবেন বলেও জানিয়েছেন। হোয়াইট হাউসে দেওয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, আমি প্যারিসকে নয়, পিটসবুর্গের মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করতে নির্বাচিত হয়েছি।

আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যেই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ দেখা হয়নি সেই চুক্তি থেকে আমরা নাম প্রত্যাহার করে নেবো, নতুবা এটি নিয়ে পুনরায় আলোচনায় বসতে হবে। তার মতে, এটি এমন একটি চুক্তি যার কারণে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কিন্তু লাভবান হবে অন্য দেশ। তিনি জানান, এই চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপিতে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হবে এবং চাকুরি হারাবে প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ। প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৮৭টি দেশ মিলে অঙ্গীকার করেছিল যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মাত্রা তারা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম রাখবে। এমনকি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি নামিয়ে আনতে চেষ্টা করবে।

বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ক্ষোভ সমালোচনা: ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পর বিশ্ব নেতারা কঠোর সমালোচনা করেছেন। ফ্রান্সের এলিসি প্রসাদে প্রথমবারের মতো ইংরেজিতে দেয়া এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় কোনো ‘প্ল্যান-বি’ নেই। কারণ আমাদের কোনো ‘প্ল্যানেট-বি’ (দ্বিতীয় গ্রহ) নেই। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত আমাদের গ্রহ এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক বড় ভুল পদক্ষেপ। তিনি ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে হতাশ মার্কিন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও নাগরিকদের জলবায়ু সমস্যা সমাধানে একসাথে কাজ করার জন্য ফ্রান্সে আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। চুক্তিতে ফ্রান্সের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন, আমরা যেখানেই বসবাস করি না কেন, যেখানেই থাকি না কেন, এই গ্রহকে শ্রেষ্ঠ করতে আমাদের সকলের দায়বদ্ধতা রয়েছে। ম্যাক্রোঁর পাশাপাশি ইউরোপের নেতারাও ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল, ইতালির প্রধানমন্ত্রী পাওলো গেন্টিলিয়োনি জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে বলেছেন, এই চুক্তি নিয়ে পুনরায় আর কোনো আলোচনা হবে না। টেলিফোনে আলাপকালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে তাদের হতাশার কথা জানিয়েছেন। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে বলেছে, এই দিনটি বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের জন্য ব্যথিত হওয়ার দিন। অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেন, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত পরিতাপের। তবে কেউ সমর্থন না দিলে এই চুক্তি বাস্তবায়ন থেমে থাকবে না। তবে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, তিনি ট্রাম্পকে বিচার করতে চান না। তবে চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া উচিত হবে না।

ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট জ্য ক্লদিয়ে জাঙ্কার ব্রাসেলসে চীনের সাথে সম্মেলনে বলেছেন, প্যারিস চুক্তিতে কোনো আঘাত আসেনি। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই অপ্রতিরোধ্য। স্বল্পোন্নত দেশের জোট গ্রুপ-৪৮ বলেছে, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে তারা হতাশ। তবে যুক্তরাষ্ট্র থাকলে বা না থাকলেও এই চুক্তি বাস্তবায়নের গতি অব্যাহত থাকবে। জাপানের অর্থমন্ত্রী তারো আসো বলেছেন, আমি শুধু হতাশ নই খুবই ক্ষুব্ধ। ভারতও জানিয়েছে তারা চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সমালোচনার ঝড়: ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পর যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও সমালোচনার ঝড় বইছে। এই চুক্তির অন্যতম সমর্থক ও সমঝোতাকারী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সমালোচনা করে বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন ভবিষ্যতকেই প্রত্যাখ্যান করছে। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, দেড় বছর আগে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বিশ্বকে সুরক্ষিত রাখতে সমঝোতার জন্য গোটা বিশ্ব প্যারিসে একত্র হয়েছিলো। বিশ্ব পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবিরাম ও নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্বের মধ্যদিয়ে সেই অর্জন সম্ভব হয়েছিলো। বিশ্বে এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের অনুপস্থিতি দেখা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া ও ওয়াশিংটনের ডেমোক্র্যাট গভর্নররা বলেছেন, তারা প্যারিস চুক্তির প্রতি সম্মান দেখাবেন। ডিজনির প্রধান নির্বাহী রবার্ট আইগার এবং উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের পর হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করেছেন। ট্রাম্প রাজনৈতিক জয়ের জন্য বিশ্বকে অবজ্ঞা করেছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছেন, আমরা সন্তানদের কাছে আরো বেশি ঋণী। বিভিন্ন রাজ্যে ডেমোক্র্যাটদের আইনজীবীরা যারা ট্রাম্পের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন তারা এবার জলবায়ু চুক্তি ইস্যুতে আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে সিনেটের মেজরিটি লিডার মিচ ম্যাককোনেল, হাউস স্পিকার পল রায়ান ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন। রায়ান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি রূঢ় চুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের কয়লা শিল্পের পক্ষ থেকেও ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। আর বিশ্বব্যাপী সমালোচনার মুখে ট্রাম্প ও তার প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি নন বলে একটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। এক খবরে বলা হয়েছে, চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে ট্রাম্প কোনো সময়সীমা বেঁধে দেননি। এই চুক্তির শর্তে বলা হয়েছে, এই চুক্তি অনুসমর্থনের তিন বছর পরই কোনো দেশ বেরিয়ে যেতে পারে।