তৃপ্তির আনন্দ কোথায়?

 

হোসেন জাকির

প্রতিটি ধর্মীয় উৎসবে আমরা নিজের খুশি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। হোক না সে ঈদ-পুঁজা-বড়দিন। সবাই আমরা আপনজনকে নিয়ে আনন্দ করি। অল্প কয়েক দিনের এই আনন্দকে ধরে রাখতে সাধ্য অতিরিক্ত ব্যয় করতে দ্বিধা করি না। অর্থ অনুযায়ী এই আনন্দ অনুভূত হয়। অর্থ অনুযায়ী এই আনন্দ কিনতে পারে। অর্থ বেশি হলে বেশি আনন্দ অনুভব করা যায়। কিন্তু সেদিন যে আনন্দ বিনা অর্থ ব্যয়ে পেয়েছি, এ রকম তৃপ্তির আনন্দ খুব কম অনুভব করা যায়।

চায়ের দোকানের পাশে একটি ঘরে বসে আছি। হঠাৎ আমার এক বন্ধু চায়ের দোকানের কর্মচারী ছোট ছেলেটিকে ডাকলো। সে জানালার কাছে আসতেই ভেতরে আসার জন্য ইশারা করলো। আমার বন্ধু তার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললো, এতে একসেট প্যান্ট-শার্ট আছে। দ্যাখতো তোর পছন্দ হয় কি-না? প্যাকেটটা হাতে নিয়ে লজ্জাভরা ছলছল চোখে, কি যেন আনন্দভরা মুখে সে দৌড়ে পালালো। সে যে কী কঠিন আনন্দ, বলে বোঝাতে পারবো না। শুধু তৃপ্তির সাথে এই আনন্দ অনুভব করতে হবে।

হযরত ওমরের (রা.) সেই ক্রীতদাস প্রথার কথা মনে করিয়ে দিলো। চাকরকে উটের পিঠে চড়িয়ে অগ্নিঝরা বালুর মধ্যে হযরত ওমরের (রা.) উটের লাগাম হাতে পথ চলার দৃশ্য দেখে ফেরেস্তারা ফুল ছিটিয়ে সংবর্ধনা জানিয়েছিলো। এই কাহিনী পড়ে গর্বে চোখে পানি এসেছিলো। আমার বন্ধুর দেয়া উপহার নিয়ে চায়ের দোকানে সেই ছোট্ট ছেলেটির চোখে যে আনন্দ দেখতে পেয়েছিলাম এর মতো তৃপ্তির আনন্দ আর দেখিনি।

আরেক দিনের ঘটনা। একজন বয়স্ক রোজাদার মুশাফির ইফতারের আগ মুহূর্তে আমাদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে। দরজা খুলতেই বললো, হাসপাতালে আমার রোগী ছিলো। রোগী রেখে আমি গ্রামে ফিরছি। আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নাই। পথে ইফতারের সময় হওয়ায় আপনার দরজায় কড়া নাড়লাম। আমাকে একটু ইফতার করাবেন? তার চেহারা দেখেই মনে হচ্ছিলো, যেন কয়েকদিনে অভুক্ত লোকটি। তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে ইফতারে বসানো হলো। কিন্তু তার অভুক্ত চেহারা দেখে আমাদের ইচ্ছে হচ্ছিলো তখনই লোকটাকে কিছু খাওয়াই। অথচ ইফতারের ১০ মিনিট বাকি। এই ১০ মিনিট সময় যেন যেতে চাচ্ছে না। ১০ মিটিন পর আজানের ধ্বনি শুনে ইফতার করার সময় তার চেহারায় যে আনন্দ দেখলাম তা পৃথিবীর অন্য যেকোনো আনন্দের চেয়ে নগন্য। রোজার যে সবচেয়ে বড় আনন্দ ইফতারে তা তার চেহারায় ফুটে উঠলো। ইফতারের পরে তাকে বাড়ি ফেরার জন্য কিছু টাকা দেয়ার সময় তার ছলছল চোখে যে আনন্দ, যে তৃপ্তি দেখলাম তাও তুলনাবিহীন। অর্থ দিয়ে এই আনন্দ কেনা যায় না।

অপরদিকে যারা পেশাগতভাবে গরিব বা ফকির, তাদের দান করা ভালো কাজ। কিন্তু তাদেরকে দান করে আপনি এতো তৃপ্তি অনুভব করতে পারবেন না। যারা দারিদ্র্যকে ব্যবসায় রূপ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের দান করে এমন তৃপ্তি অনুভব করা যায় না। কিন্তু যারা দরিদ্র, নিজেরা দৈহিক পরিশ্রম করে একবেলা না খেয়ে থাকলেও অপরের কাছে হাত পাততে চায় না। অভাবের সাথে লড়াই করে কখনো কখনো পিছিয়ে যায়। আবার চেষ্টা করে এগুনোর। এ ধরনের লোকজনকে সাহায্য করে তৃপ্তি আনন্দ অনুভব করতে পারবেন। কিন্তু ফলাও করে দু-পাঁচশ লোককে দান করবেন, সবাই জানতে পারবে। সেখানে পেশাগত গরিব লোক বেশি পাবেন। যারা দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে তাদের আপনি কম দেখতে পাবেন। কারণ গরিব হলেও তাদের মধ্যে লজ্জার মাত্রাটা খুব বেশি থাকে। মহল্লায় মহল্লায় এদেরকে চিহ্নিত করে গোপনে দান করতে হবে। তাহলে তাদের চেহারায় ফুটে ওঠা আনন্দের ঝর্ণাধারা অনুভব করতে পারবেন।