প্রকাশ্যে নির্মম নির্যাতন ॥ ঘরে বন্দির কিছুক্ষণের মাথায় আগুনে পোড়া লাশ উদ্ধার

আলমডাঙ্গার প্রাগপুরে প্রবাসফেরত মাথা বিগড়ানো ব্যক্তি ফারুক হোসেনকে বাঁচতে দিলো না তার চাচাতো দু ভাই

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: আলমডাঙ্গার প্রাগপুরে প্রবাস ফেরত মাথা বিগড়ানো এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার পর আগুনে পোড়ানো হয়েছে। গতকাল রোববার সকাল ১১টার দিকে চাচার ঘর থেকে লাশ বের করার পর নিহতের শোকার্ত পিতাসহ প্রতিবেশীরা এ অভিযোগ করে বলেছে সকালে তাকে প্রকাশ্যেই মারপিট করে চাচাতো ভাইসহ কয়েকজন। মারতে মারতে তাকে যে ঘরে নেয়া হয়, সেই ঘর থেকেই পরে বের করা হয় আগুনে পোড়া লাশ। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে গতকালই চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়েছে। আলমডাঙ্গা থানায় রুজু করা হয়েছে অপমৃত্যু মামলা। পুলিশ এ তথ্য দিয়ে বলেছে, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। কেননা, ফারুকের পিতা নিজেই অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেছেন। অভিযুক্তদের তরফে বলা হয়েছে, মানসিক প্রতিবন্ধী নিজেই ঘরে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
নিহত ফারুক হোসেন (৩৪) প্রাগপুর গ্রামের চায়েন উদ্দীনের ছেলে। চাচা মোতালেব আলীর বাড়ির বৈদ্যুতিক মিটার ভাঙার অভিযোগে তার ছেলে মজিদ, রেজাউল ও তাদের সহযোগি গ্রামেরই ইজালের ছেলে রফিকুল গতকাল রোববার সকালে ফারুক হোসেনকে মারপিট করে। অমানসিকভাবে মারপিট করেই তারা ক্ষ্যান্ত হয়নি, তাকে মোতালেবের একটি কক্ষে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। এর কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে ধুয়া বের হচ্ছে বলে জোর প্রচার-প্রচারণা চালানো হলে প্রতিবেশীরা ছুটে গিয়ে তালা ভেঙে বের করে আগুনে পোড়া ফারুকের মৃতদেহ। গ্রামবাসীর মধ্যে ক্ষোভ দানা বাধলেও মোতালেব ও তার ছেলেদের বিরুদ্ধে তেমন কাউকে রুখে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। খবর পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। এ সময় পুলিশের এক সদস্য বলেছেন, কয়েকদিন আগেই এদের বিরোধ মিটিয়ে দেয়া হলো। অথচ থামলো না। মাথা বিগড়ানো সরল-সোজা মানুষটাকে ওরা মেরেই ফেললো!
স্থানীয়রা বলেছে, ফারুক হোসেন স্ত্রী সন্তান রেখে ৫-৭ বছর আগে ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর স্বপ্নে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমায়। সেখানে দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে বছরখানেক আগে বাড়ি ফেরে। মানসিক রোগীর মতো আচরণ করতে থাকে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ফিরে যায় বাপের বাড়ি। এরপর ফারুকের পাগলামিটা বাড়তে থাকে। মেয়ে দেখলেই বিয়ে করতে চায় সে। এ নিয়ে হাসাহাসির খোরাক হলেও ওর চাচাতো ভাই মজিদ ও রেজাউলদের চোখের সুল হয়ে দাঁড়ায়। মস্তিষ্ক বিকৃত রোগে আক্রান্ত চাচাতো ভাইয়ের চিকিৎসার বদলে ঘুরে ফিরেই ওরা মারধর করতে থাকে। সম্প্রতি মজিদ-রেজউলদের বাড়ির বৈদ্যুতিক মিটার ভাঙা দেখে ফারুক হোসেনকেই দোষারোপ করা হয়। তাকে শুধু মারধরই করা হয়নি, তার বাড়িতে গিয়ে দরজা জানালাও ভাঙচুর করে মজিদ-রেজাউল গং। এ বিষয়ে নিকটস্থ পুলিশ ফাঁড়িতে নালিশও করা হয়। পুলিশের তরফে নামকাওয়াস্তে মিটমাট করে দেয়া হয়। গতকাল সকালে ফারুক হোসেনকে সামনে পেয়ে চাচাতো দুভাইসহ তাদের সহযোগী রফিকুল বেদম লাঠিপেটা করতে শুরু করে। মারতে মারতে বাড়ির ভেতর নিয়ে একটি ঘরে আটকে রাখে। চাচাতো ভাইরা তাদের পাগল চাচাতো ভাইকে মারছে দেখে প্রতিবেশীদের তেমন কেউ ঠেকাতে যাননি। এর আগেও মারধর করা হয়েছে। ঠেকাতে গেলে উল্টো প্রতিবেশীদের রোষানলে পড়তে হয়। গতকাল মারপিটের পর যখন আগুনে পোড়া লাশ ঘর থেকে বের করা হয়, তখন ক্ষোভে ঘৃণায় চাচাতো ভাইদের ছি! ছি! করতে থাকেন সকলে। এরপরও ঘটনা অন্যদিকে নেয়ার জন্য তারা বলে-ফারুককে ঘরে আটকে রাখার কারণে সে আত্মহত্যা করেছে। অথচ ঘরে বেধে রাখা অবস্থায় একজন মানসিক প্রতিবন্ধী কীভাবে আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করলো? এ প্রশ্নের যেমন জবাব মেলেনি, তেমনই অগ্নিদগ্ধ হওয়ার সময় তার চিৎকারও কেউ শুনতে পেলো না কেন? এ প্রশ্নেরও জবাব মেলেনি।
এ ব্যাপারে নিহত ফারুক হোসেনের দুলাভাই মিরপুর উপজেলার আবুরী গ্রামের আহমেদ আলী বলেন, সকালে আব্দুল মজিদ তাকে ২ দফা মোবাইলফোনে কথা বলে। ১ম দফায় জানায়, ফারুককে তারা ঘরে আটকে রেখেছে। বন্ড দিয়ে আহমেদ আলী যেন ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। পরে আবার রিং দিয়ে জানায় যে ফারুক হোসেন আত্মহত্যা করেছে। আলমডাঙ্গা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) লুৎফুল কবীর জানিয়েছেন, লাশ তদন্তের জন্য পাঠানো হবে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।