হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার এক বছর : আজ উন্মুক্ত থাকবে ৪ ঘণ্টা

নেপথ্যের মদদদাতারা থেকে গেলো নেপথ্যেই

স্টাফ রিপোর্টার: গুলশানের হলি আর্টিজানে নারকীয় জঙ্গি হামলার পর এক বছর কেটে গেলো। ভয়ঙ্কর সেই ঘটনা এখনও দেশবাসীকে নাড়া দেয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপকভাবে আলোচিত এই জঙ্গি হামলার পর দেশ জুড়ে শুরু হয় পুলিশ ও র‌্যাবের জঙ্গি বিরোধী অভিযান। এসব অভিযানে হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় জড়িত ও পরিকল্পনাকারীদের শনাক্ত করার দাবি করে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। কার্যত এ ঘটনায় পর্দার আড়াল থেকে যারা ইন্ধন যুগিয়েছে তারা থেকে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হলি আর্টিজানে হামলার ইন্ধনকারী হিসেবে গোয়েন্দাদের খাতায় নাম উঠেছে মাওলানা শাকের নামে একজন ব্রিটিশ নাগরিকের। তার সাথে তাজউদ্দিন নামে লক্ষ্মীপুরের এক দুর্ধর্ষ জঙ্গি রয়েছেন যিনি সিরিয়াতে আইএসের পক্ষে যুদ্ধ করছেন। তাজউদ্দিনের সাথে শাকেরের যোগসূত্র রয়েছে। কয়েকদিন আগে লক্ষ্মীপুরের একটি মাদরাসার খতিব মুফতি মুস্তাকুন্নবীকে গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে নিয়ে গেছে। মুস্তাকুন্নবীর সাথেও তাজউদ্দিনের যোগাযোগ ছিলো। শাকেরের বিরুদ্ধে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে জঙ্গি কার্যক্রম প্রচারণার অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশে জঙ্গিদের অবস্থান জানানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে হলি আর্টিজানে  হামলা চালানো হয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনগুলোর আন্তর্জাতিক মদদদাতারা এই হামলার পেছনে ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে। তাদের সাথে হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গিদের চেইনে এতটাই দূরত্ব রয়েছে যে ওই আন্তর্জাতিক জঙ্গি চক্রগুলোর জড়িত থাকার দালিলিক কোনো প্রমাণ মেলাতে পারছে না ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। একই সাথে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব নয় বলেই এই ঘটনায় শুধু হামলাকারী, অস্ত্র সরবরাহকারী ও অর্থ যোগানদাতাদের পরিচয় জানা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে গোয়েন্দা সংস্থা।

আজ ১ জুলাই। ভয়ংকর সেই জঙ্গি হামলার এক বছর। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য অনেকেই আজ ভিড় জমাচ্ছেন গুলশান-২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর প্লটের বাড়িটিতে। হোলি আর্টিজান বেকারির সেই আগের ভবনটি আগামীকাল চার ঘণ্টার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বেকারির আগের সেই বাড়িটিতে মালিকপক্ষ নিজেদের থাকার জন্য মেরামতের কাজ করছে। তবে এখন ভবনের সামনে শাদা কাপড়ে মোড়ানো লম্বা আকৃতির একটি ডায়াসের মতো তৈরি করা হচ্ছে। আর্টিজানের মালিকদের একজন সাদাত মেহেদী বলেন, ‘যে কেউ এসে ভবনের সামনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন। আগামীকাল সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।’ গত বছরের ১ জুলাই রাতে হোলি আর্টিজান বেকারিতে সশস্ত্র হামলা চালায় ৫ জঙ্গি। জঙ্গিরা ৯ জন ইতালিয়ান, ৭ জন জাপানি, একজন ভারতীয় নাগরিক এবং বাংলাদেশের ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবীর, ইশরাত আখন্দ এবং দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে, এই উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে রাত কাটে। পরদিন সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে সেখানে যৌথ বাহিনী অভিযান চালায়। অভিযানে নিহত হয় ৫ জঙ্গি। অবসান ঘটে প্রায় ১১ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির। জঙ্গি হামলার পর প্রায় সাড়ে ৪ মাস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকে হোলি আর্টিজান প্রাঙ্গণ। গত বছরের ১৩ নভেম্বর পুলিশ মালিককে এর দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়।

তবে মালিকপক্ষ জানায়, ভবনটিতে তারা কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করবে না। দোতলা ওই ভবন নিজেদের বাসস্থান হিসেবে গড়ে তুলবে তারা। সে জন্য এখন চলছে মেরামতের কাজ। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে আগামীকাল (আজ) শ্রদ্ধা জানাতে ভবনটি ৪ ঘণ্টার জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে। এ বছরের ১০ জানুয়ারি থেকে গুলশান নর্থ অ্যাভিনিউতে হোলি আর্টিজান বেকারির একটি শাখা চালু করেছে মালিকপক্ষ। র‍্যাংগস্‌ আর্কেডের দোতলায়, সুপারশপ গরমেট বাজারের একটি অংশে ৫০০ বর্গফুটের মতো জায়গায় বেকারির কার্যক্রম চলছে।

এদিকে, গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত নব্য জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর ২৪ কর্মীর জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিসিটিসি) বিভাগের প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘হলি আর্টিজানে হামলার মামলার তদন্ত এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকার প্রেক্ষিতে আমরা এ পর্যন্ত ওই হামলার ঘটনায় ২৪ জন নব্য জেএমবি কর্মীর সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। ওই মামলার চার্জশিট শিগগিরই আদালতে দাখিল করা হবে।’

সিসিটিসি প্রধান বলেন, জুলাইয়ে হলি আর্টিজান রেস্তোঁরায় হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, জঙ্গি প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের সাথে এ পর্যন্ত ২৪ জঙ্গির সংশ্লিষ্টতা দেখা গেছে। এদের মধ্যে দুজন ওই হামলা সংঘটিত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে লড়াইয়ে ২৪ জনের মধ্যে ইতোমধ্যে ১৫ জন মারা গেছে। ৪ জন জেলে রয়েছে, অপর ৫ জন পলাতক।’ যে ৮ জন জঙ্গি বিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে তারা হলো— তামিম চৌধুরী, নূরুল ইসলাম মারজান, মেজর জাহিদুল ইসলাম, সারোয়ার জাহান, তানভীর কাদেরি, মো. আব্দুল্লাহ ওরফে রনী, আবু রায়হান ওরফে তারেক ও ফরিদুল ইসলাম আকাশ।