জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে বাণিজ্য : টাকা না দিলে বছরের পর বছর পড়ে থাকছে সংশোধনের আবেদন

স্টাফ রিপোর্টার: জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সেবা গ্রহণকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য কমছেই না। নাগরিকদের কৃত্রিম ভোগান্তি সৃষ্টি করে একটি সিন্ডিকেট এই বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িয়ে পড়েছেন এই বাণিজ্যে। অর্থের বিনিময়ে পরিচয়পত্র প্রদান হরহামেশাই ঘটছে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে এ ধরনের একাধিক অভিযোগ এসেছে। অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর জাল, কর্তৃপক্ষের সাথে প্রতারণা, আর্থিক দুর্নীতি ও সেবা গ্রহণকারীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে চাকরি হারিয়েছেন ইসির প্রায় দুই ডজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তবে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন উইংয়ের তুলনায় স্মার্টকার্ড বিতরণ কর্তৃপক্ষ বা আইডিইএ প্রকল্পের সংশ্লিস্টরাই দুর্নীতিতে এগিয়ে রয়েছেন। তালিকা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চাকরিচ্যুত ১৮ জনের মধ্যে ১৪ জনই আইডিইএ প্রকল্পের।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন উইংয়ের পরিচালক (অপারেশন) মো. আবদুল বাতেন বলেন, যারা দুর্নীতি অনিয়মের সাথে জড়িত থাকবে তাদের ছাড় নেই। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, এনআইডি সেবা নিতে গেলে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হতে হয়। বিশেষ করে যেসব ভোটারের এসএসসি সনদ নেই-তাদের ওপর নামে খড়গ। এ ধরনের সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে এনআইডি সংশোধনের নামে চলে দেনদরবার। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী যোগসাজশে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার নামে রমরমা বাণিজ্য করছে। নির্বাচন কমিশন থেকে অনুমতিপত্র দেয়ার নামে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে অর্থ। আবার কোনো কোনো কর্মকর্তা প্রকল্পে ফোন করে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার নামে টাকাও নিচ্ছে। সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির নামে আদায় করা হচ্ছে অর্থ। টাকা না দিলে বছরের পর বছর পড়ে থাকছে সংশোধনের আবেদন। বিশেষ করে ইসির উপজেলা পর্যায়ের অফিসের সাথে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।

দুর্নীতির ঘটনায় ইসির গঠিত তদন্ত প্রতিবেদন ঘেটে দেখা গেছে, আইডিইএ প্রকল্পের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মো. জাকির হোসেন।  কাজে যতোটুকু অভিজ্ঞ, তার চেয়ে বেশি পারদর্শী অনিয়ম-দুর্নীতিতে। তাই মঞ্জুর এহসান নামে এক ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র থাকা ছবি বদলে অন্যের ছবি বসাতে এতোটুকু বেগ পেতে হয়নি তার। মঞ্জুরের আইডি নং-১৯৬৪৫০১৭৯৭৫২১৬৪৮৫। এই পরিচয়পত্রে থাকা ছবি বদলে ফেলেন তিনি। এর বিনিময়ে আর্থিকভাবে লাভবান হন তিনিসহ তার সহকর্মী টেকনিক্যাল সার্পোট ইয়াসির আরাফাত। এই ঘটনায় ইসির গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর দু’জনেরই চাকরি চলে যায়।

২০১৫ সালের ১৫ জুন সামসুন নাহার নামে একজনের জন্ম তারিখ ১৩ বছর কমিয়ে দিয়ে অর্থ দাবি করায় চাকরি হারিয়েছেন প্রকল্পের টেকনিক্যাল সার্পোট ইকবাল হোসেন। যদিও ঘটনায় আর্থিক লেনদের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। একইভাবে আলমগীর হোসেন নামে এক ব্যক্তির ত্রুটি এতোটাই অবান্তর যা সংশোধন করা জাতীয় পরিচয়পত্র কর্তৃপক্ষের পক্ষে অসম্ভব। সংশ্লিস্ট ব্যক্তির তথ্য ঘেঁটে কর্তৃপক্ষ আলমগীর হোসেনকে এ কথা জানান। কিন্তু আইডিইএ প্রকল্পের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অমান্য করে আলমগীর হোসেনের পরিচয়পত্রে থাকা জন্ম তারিখ ও পিতার নাম অবৈধভাবে সংশোধন করে ফেলেন। ২০১৫ সালের ১৫ জুন চাকরি খুঁইয়ে কৃতকর্মের মাশুল দেন আইডিইএ প্রকল্পের এই কর্মকর্তা।

২০১৫ সালের ১৭ জুন প্রকল্পের সহকারী পরিচালক (প্রিন্ট) মোস্তফা হাসান ইমাম ও টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মো. মাহমুদ হাসানের চাকরি যায় অবৈধ পন্থায় একজনের জন্মতারিখ সংশোধন করার অপরাধে। দেখা গেছে, আবদুল হালিম সরদারের জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি জন্মতারিখ সংশোধন করে করা হয় ১৯৮৬ সালের ৫ জানুয়ারি। এ অপরাধে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। এনআইডি উইং ও আইডিইএ প্রকল্পের মহাপরিচালকের স্বাক্ষর জাল করার অপরাধে প্রকল্প থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. আবু বকর ছিদ্দিককে।

চট্টগ্রামের খুলশী থানার একজন নাগরিকের পিতা ও মাতার নাম সংশোধন করা হয় কোনো ধরনের দালিলিক প্রমাণ ছাড়াই। এই অপরাধে প্রকল্পের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মার্জিয়া আক্তার লিজা, শেখ সেলিম শান্ত ও মো. সোলায়মানকে প্রত্যাহার করা হয় প্রকল্প থেকে।

সেবা গ্রহণকারী ব্যক্তিদের পরিচয়পত্র দ্রুত পাইয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে প্রকল্প থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে আইডিইএ প্রকল্পের তিনজন আনসার সদস্যকে। এরা হলেন শাহীনউদ্দিন, জাহিদুল ইসলাম ও নয়ন ইসলাম। ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সাবেদুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়েছে টাকার বিনিময়ে পরিচয়পত্র প্রিন্ট করার অপরাধে।

নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলা অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সুতপা রানীর চাকরি যায় অবৈধভাবে একজনের জন্মতারিখ সংশোধন করে দেয়ার অপরাধে। অফিসারের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে আইডি সংশোধন করায় সাভার অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর রবিউল করিমের চাকরি যায়। অনিয়মতান্ত্রিকভাবে একজন ভোটারের ঠিকানা স্থানান্তর করার অপরাধে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে জাতীয় নিবন্ধন অণুবিভাগের সহকারী প্রোগ্রামার মো. সিরাজুল ইসলামকে। নির্বাচন কর্মকর্তার অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে কার্ড সংশোধন ও ভোটার নিবন্ধনের অভিযোগ বিভাগীয় মামলা হয়েছে চট্টগ্রাম কোতয়ালী থানা নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মোস্তফা ফারুকের বিরুদ্ধে। পরিচয়পত্র সংশোধনে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে বিভাগীয় মামলা দায়ের ও বরখাস্ত করা হয়েছে গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. ইকবাল হোসেন, নেত্রকোনার পূর্বধলা নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মাহমুদুল ইসলাম, গাজীপুরের শ্রীপুর নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. বাবুল আহম্মেদ ও রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর জাকির হোসেনকে। ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এরা চাকরি হারান।