প্রজন্মের পদে পদে হুচোট কি বড়দের লজ্জার নয়?

স্মার্টফোন প্রজন্মকে ‘স্মার্ট’ করলেও কেউ কেউ তার অপব্যবহারে যেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে পথে-ঘাটে, তেমনই অতিমাত্রায় ব্যবহারে অসতর্কতার কারণে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকির পাশাপাশি প্রাণহানিও ঘটছে। নিজের মোবাইলফোনে নিজেই নিজের ছবি তোলা তথা নিজস্বী বা সেলফি নিতে গিয়ে হরহামেশাই তরতাজা প্রাণ ঝরে পড়ার খবরও যেন গাসওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। কানে ছোট মাইক গুজে গান শুনতে শুনতে কিংবা ব্লুটুথ ইয়ারফোন কানে গুজে কথা বলতে বলতে হাঁটতে গিয়েও দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ব্যস্ত রাস্তাতেও ফেসবুকে কিংবা অন্য কোনো যোগাযোগ মাধ্যমে চ্যাটিং করার সময় হুড়মুড়িয়ে পড়ার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। প্রতিকার? উদাসীনতায় আমাদের চরম খেসারত দিতে হয়। অলসতা অগ্রযাত্রায় বড় বাধা, উন্নয়নে অন্তরায়।
বর্তমান পৃথিবীর বাসিন্দারা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সময় অতিক্রম করছে বললে কি খুব ভুল বলা হয়? মানুষ যেদিন মানুষ হয়েছে তারপর থেকে প্রযুক্তির ¯্রােত বেড়েছে। কখনও কখনও ¯্রােত পেয়েছে চক্রবৃদ্ধি গতি। মানুষ তার প্রয়োজনেই পাল্টে নিয়েছে পুরো পৃথিবী। দ্রুত পরিবর্তনের সিংহভাগ ইতিবাচক হলেও কিছুটা নেতিবাচক প্রভাবও স্পষ্ট। এই পরিবর্তনের ধকল মূলত প্রজন্মকেই সামলাতে হয়। এ কথা এখন আর অস্বীকার করার জো নেই যে, যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দখলে প্রজন্মের অনেকের জীবনই বেসামাল। অথচ বাঙালি ছাড়া বিশ্বের প্রায় সকল জাতির প্রজন্মই ধকল সামলে তরতরিয়ে উঠছে সাফল্যের শিখরে। অথচ যদি জ্ঞান-বিজ্ঞানে বাঙালির রয়েছে গৌরবান্বিত অতীত। কয়েকশ বছর আগে এখনকার মতো হতো তাহলে বিশ্বে অতো শত ভাষার বদলে মনের ভাবপ্রকাশের শব্দগুলো প্রায় সবই অভিন্ন হতো। সময়ের ¯্রােতে প্রয়োজনের তাগিদে নতুন নতুন যে শব্দগুলো সৃষ্টি করছে মানুষ তা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, তা যেন নিজেরই আবিষ্কার বলে উপলব্ধি হচ্ছে। ভাবার্থে অভিন্নতা বলতে কিছুই থাকছে না। অ্যাপ, সেলফি, চ্যাট, চ্যাটিং শব্দগুলোর মতো অন্য শব্দগুলোও উদ্ভবের সময় এখনকার মতো সমানতালে ছড়াতো বিশ্বজুড়ে তাহলে কি মনের ভাব প্রকাশের শব্দগুলো অতোটা বিচিত্র হতো? নিশ্চয় না। যেখানে যোগাযোগে ব্যবস্থা যতো দুর্গম, সেখানে ভাষার রকমফেরও ততোটা বিচিত্র। ভাগ্যিস তথ্যপ্রযুক্তির বহু পূর্বেই মানুষের মনের ভাব প্রকাশের প্রয়োজন পড়েছে। আর তারই বদৌলতে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রাণের ভাষা, মাতৃভাষা বাংলা। যে বাংলাভাষার শব্দে সমৃদ্ধতার বিচার বিশ্লেষণে বিশ্ববাসী এখনও চমকে ওঠে, সেই বাংলার পূর্বপূরুষেরা নিশ্চয় এতোটা বোকা ছিলো না। তাহলে তাদের উত্তরসূরিদের মধ্যে এখন এতোটা বোকামি কেন? অবশ্যই বিশ্বের সাথে তাল মেলানোর মতো সবরকমের সামর্থ্য রয়েছে আমাদের। দরকার শুধু একটু সচেতনতা। দূরদর্শিতা। কি করলে কী হয়ে তা ভেবে পথ চললে সামনের বাঁক যতোটাই আচমকা হোক না কেন, দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকে না। যে জাতি গাছের প্রাণ আবিষ্কার করেছে, যে উপমহাদেশের মানুষ অঙ্কে ‘শূন্য’ আর ’দশমিক’ আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্বভ্রমা-ের হিসেবসহ সবকিছু সহজ করে দিয়েছে, সেই উপমহাদেশের মানুষ জ্ঞান প্রজ্ঞায় পিছিয়ে ছিলো বা আছে তা কি বলা যায়? চর্চার অভাবে জ্ঞান প্রজ্ঞায় মরিচা পড়ে। চিড় ধরে আত্মবিশ্বাসে। আমাদের ক্ষেত্রেও কি তাই? তা না হলে উঠতি বয়সীদের মধ্যে সেলফোন নিয়ে এতো বাড়াবাড়িই বা কেন, কেনই বা বোকামি?
স্মার্টফোন এখন এতোটাই প্রয়োজনীয় যে, ওটা ছাড়া জীবনযাত্রাই যেন অচল। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্বজনদের সাথে চোখের পলকে সরাসরি চলমানচিত্রে কথোপকথন বিজ্ঞানের কি কম সাফল্য? তাহলে এই সাফল্যের সেলফোন ব্যবহারে সামান্য সতর্কতা অবলম্বন নয় কেন? প্রজন্মকে প্রযুক্তির সুবাতাস থেকে সরিয়ে রাখার বদলে তা ইতিবাচক ব্যবহারে উদ্বুব্ধ করাই কি বুদ্ধিমান অভিভাবকের দায়িত্বশীলতা নয়? অবশ্যই অন্ধকারের চেয়ে আলোই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়। সচেতনতার আলো ছড়াতে হবে, বাড়াতে হবে জ্ঞানের পরিধি। বিশ্বজুড়ে প্রজন্মের অগ্রযাত্রার খবর যখন প্রতিদিনই গণমাধ্যমের খোরাক, তখন আমাদের প্রজন্মের পদে পদে হুচোট কি বর্তমানের বড়দের লজ্জার নয়? বড়দের জ্ঞানের আলো নিশ্চয় প্রজন্মকে হুচোট খাওয়া থেকে বাঁচাবে, স্বপ্নজয়ে করবে আত্মবিশ্বাসী।