গাংনীর ইউপি সদস্য কামাল হত্যা ॥ আসামিদের বাড়িঘরে ব্যাপক লুটতরাজ ভাঙচুর

ষোলটাকা থেকে ফিরে মাজেদুল হক মানিক: মেহেরপুর গাংনীর ষোলটাকা গ্রামের ১৩টি বাড়িঘরে ব্যাপক লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা ইউপি সদস্য কামাল হোসেন হত্যা মামলার আসামি। হত্যাকা-ের প্রতিশোধ নিতে মামলার বাদী ও তার লোকজন লুটতরাজ চালিয়েছে বলে অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্তদের। ওই পরিবারগুলোর নারীরা বাড়ি ফিরলেও বসবাসের কুল-কিনারা পাচ্ছেন না। বাড়িঘরে লুটপাটের পাশাপাশি পুকুর থেকে দেড় কোটি টাকার মাছ লুট করে বাদী ফারুক হোসেন ও নিহত কামালের চাচাতো ভাই ইন্তাজ আলী ইন্তা বিক্রি করেছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। ভাঙচুর ও লুটপাটের সাথে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারপূর্বক সাজা দাবি করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা।
সরেজমিন ষোলটাকা গ্রাম ঘুরে ভাঙচুর ও লুটপাটের শিকার পরিবারগুলোতে দেখা গেছে মানুষ শূন্য। হত্যাকা-ের পর থেকেই পুরুষদের পাশাপাশি নারী ও শিশুরাও নিরাপদে চলে যান। দুয়েকজন নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ বাড়িঘরের দরজা-জানালা ভাঙা এবং আসবাবপত্রসহ ঘরের কোন মালামাল পাননি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কামাল মেম্বারের মরদেহ দাফনের পর থেকেই শুরু হয় তার পক্ষের লোকজনের তা-ব। নিহত কামাল হোসেনের ভাতিজা হত্যা মামলার বাদী ফারুক হোসেন ও কামালের চাচাতো ভাই ইন্তাজ আলী ইন্তার নেতৃত্বে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। গরু-ছাগল, নগদ টাকা, সোনার গয়না, আসবাবপত্রসহ বাড়ির সব মালামাল তারা লুটে নিয়ে বিক্রি করেছে। তাদেরকে হায়েনা আখ্যায়িত করে ভুক্তভোগী পরিবারের কয়েকজন নারী বলেন, বাড়িঘর ভাংচুরের পাশাপাশি সব কিছুই নিয়ে গেছে।
ষোলটাকা গ্রামের বিছার উদ্দীনের আট ছেলের মধ্যে সাবাতুল্লাহ, রহমতুল্লাহ, রফাতুল্লাহ ও সবাতুল্লাহর ছোট ছেলে রাজু আহম্মেদ হত্যা মামলার আসামি। ওই পরিবারের চারজন ছাড়াও বিছার উদ্দীন ও তার ছেলে শিপাতুল্লাহ, রিফাতুল্লাহ, রাহাতুল্লাহ, আব্দুলসহ আট ছেলের কারো বাড়িঘরে কোন মালামাল নেই। ঘরের ছাউনির টিন পর্যন্ত লুট করা হয়েছে। অপরদিকে রাহাতুল্লাহর বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছিলো। আগুনে রান্নাঘর, গোয়ালঘর পুড়ে যায়। সময়মত আগুন নেভাতে না দেয়ায় বাড়ির আঙ্গিনায় থাকা গাছপালাও আগুনে পুড়ে গেছে।
রাহাতুল্লাহর স্ত্রী তানিয়া খাতুন বলেন, আমাদের পরিবার থেকে পাওয়াল ট্রিলার, ফ্রিজ, টিভি, ফ্যান, আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড়, থালা-বাসন, ধান-চাউল, সোনার গয়না, নগদ টাকাসহ বাড়ির সব মালামাল লুট করেছে। আসামিদের বাড়িঘরে যা লুটপাট করা হয়েছে তার আর্থিক মূল্য কোটি টাকার উপরে হবে।
এদিকে কামাল হত্যা মামলার প্রধান আসামি আলমগীর হোসেন, অন্যতম আসামি মাজেদুল ইসলাম, গনি ও পল্লী চিকিৎসক মালেকের বাড়িঘরে একই কায়দায় লুটপাট এবং ভাংচুর করা হয়েছে। বাড়িগুলোতে এখন শুনশান নিরবতা। মাজেদুল ইসলামের ছাদের বাড়ির বিভিন্ন স্থানে হেমার দিয়ে ভাঙচুর করা হয়। যার চিহ্ন এখনো রয়েছে। ছাদে বড় দুটি ছিদ্র করে পুরো ছাদ বিনষ্ট করা হয়েছে। বাড়িতে থাকা নগদ টাকা, ৫০ বস্তা মাছের খাবার, ছাগল ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মাজেদুল ইসলামের স্ত্রী রাহেনা খাতুন। তাদের নগ্ন হামলায় টিউবওয়েল ও বৈদ্যুতিক মিটার রক্ষা পায়নি বলে জানালেন মাজেদুলের বোন কল্পনা খাতুন। ষোলটাকা গ্রাম মৎস্য চাষ প্রধান গ্রাম। প্রতিটি পরিবারেরই রয়েছে কয়েকটি পুকুরে মাছ চাষ। মামলার আসামিরা বাড়িছাড়া হলে ফারুক ও ইন্তার নেতৃত্বে আসামিদের পুকুর থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে মাছ লুট করে মেহেরপুর শহরের মৎস্য আড়তে বিক্রি করা হয়েছে। এ অভিযোগ করে ভুক্তভোগী রহমতুল্লাহর মেয়ে রতœা খাতুন বলেন, পাঙ্গাস ও মনোসেক্স মাছ ধরার মরসুম চলছিলো। তারা প্রায় দেড় কোটি টাকার মাছ লুট করে নিয়ে গেছে। মাছ ধরতে মাজেদুল ও রহমতুল্লাহর জাল ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও বাড়ির পাশের গুদাম ভেঙ্গে রহমতুল্লাহর প্রায় ১শ’ বস্তা মাছের খাবার লুট করে নিয়ে গেছে। বাড়িঘরের তা-বের পাশাপাশি গাছ ও মাঠের ক্ষেতের পাট কেটে দিয়েছে বাদি পক্ষের লোকজন। হত্যা মামলায় জড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে তারা দিনেরাতে এ জঘন্য হামলা চালিয়েছে বলে জানালেন ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের নারী সদস্যরা।
নিহত কামাল হোসেনের ভাতিজা ফারুক হোসেন, কামাল হোসেনের চাচাতো ভাই ইন্তা ও তার ভাই রহিদ, রহিদ, আব্দুল্লাহ, ফরজ, আব্দুল্লহর ছেলে সেলিম ও সুমন, ইন্তার ছেলে বাচ্চু, রহিদের ছেলে রাফিকুল, শুকুর বিশ^াসের ছেলে আশা ও সাহিদুল, কফেল উদ্দীনের ছেলে রাব্বি, আব্দুল হান্নানের ছেলে জাহিদুলসহ তাদের পক্ষের অর্ধ শতাধিক নারী-পুরুষ দিনেরাতে লুটপাট ও ভাংচুর চালায় বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীর।
ভুক্তভোগীরা বলেন, কামাল হত্যা মামলার বিচার হচ্ছে। আসামিরা আদালতে আত্মসমর্পণ করে এখন হাজতবাসে রয়েছেন। তবে ভাঙচুর ও লুটপাটের কারণে পরিবারগুলো এখন শ্মশানে পরিণত। এখানে বসবাসের কোনো উপায় নেই। হত্যা মামলার বিচার হলে তা-বকারীদের কোনো বিচার হবে না? দ্রুত তাদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দাবি করলেন তারা। ভাঙচুর ও লুটপাটের বিষয়ে তারা আদালতে মামলা করেছেন বলে জানালেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে, প্রধান অভিযুক্ত ইন্তাজ আলী ইন্তা অস্বীকার করে বলেন, আমি অসুস্থ মানুষ। এসব ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। যতোটুকু পেরেছি ঠেকিয়েছি। পূর্বশত্রুতার জের ধরে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে। তবে গ্রামে পাওয়া যায়নি আরেক প্রধান অভিযুক্ত ফারুক আহম্মেদকে। এ প্রসঙ্গে গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে বিষয়টি তদন্ত করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললেন তিনি।
উল্লেখ্য, ষোলটাকা ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ড সদস্য ষোলটাকা গ্রামের মৃত আব্দুস সাত্তারের ছেলে কামাল হোসেনকে (৪২) পূর্ববিরোধের জের ধরে গত ২৫ মে সকালে বাড়ির অদূরে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। কামাল হোসেনের ভাতিজা ফারুক হোসেন বাদী হয়ে ১২ জনকে আসামি করে থানায় হত্যামামলা দায়ের করেন। এদের মধ্যে একজন জামিনে, একজন গ্রেফতার ও বাকিরা সম্প্রতি আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন।