গাংনীতে প্রবাসীর স্ত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যা ?

স্বামীর পাঠানো টাকা নিয়ে পোদ্দারি করা দেবরের বিরুদ্ধে অভিযোগ
মাজেদুল হক মানিক: মেহেরপুর গাংনী উপজেলার জোড়পুকুরিয়া গ্রামে চম্পা খাতুন (৩০) নামের এক গৃহবধূকে শ্বাসরোধ করে হত্যার অভিযোগ উঠছে। গতকাল বুধবার ভোর থেকে মৃত্যুর কারণ নিয়ে দেবরের নানা নাটক সাজানোর পর অবশেষে দুপুরে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য প্রেরণ করেছে পুলিশ। অবস্থা বেগতিক দেখে আত্মগোপন করেছে পুলিশ। গৃহবধূর পিতার পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। নিহত চম্পা খাতুন জোড়পুকুরিয়া গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী শাহীন উদ্দীনের স্ত্রী এবং পাশর্^বর্তী তেরাইল গ্রামের জহির উদ্দীন শাহের মেয়ে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শাহীন উদ্দীন প্রায় ১০ বছর ধরে মালয়েশিয়া প্রবাসী। অষ্টম শ্রেণিতে পড়–য়া একমাত্র ছেলেকে নিয়ে পিতার বাড়িতেই বসবাস করতেন তার স্ত্রী। কিছুদিন আগে থেকে স্বামীর বাড়িতে ফিরে আসেন। তার স্বামী, ছোট দেবর ও শাাশুড়ি একই সংসারে। ঈদের দুই দিন আগে বাড়ি ফেরেন চম্পার দেবর রাহেন উদ্দীন। একতলা ছাদের বাড়ির একটি দক্ষের দরজা-জানালা থাকলেও বাকিগুলো এখনো কাজ সম্পন্ন হয়নি। দরজা লাগানো কক্ষে চম্পা, পাশের কক্ষের তার শাাশুড়ি ও ছেলে এবং বারান্দায় রাতে শুয়ে থাকতেন রাহেন উদ্দীন। গতকাল বুধবার সকালে গ্রামের এক চিকিৎসককে চম্পার অসুস্থতার খবর দিয়ে সেখানে যেতে বলেন। চিকিৎসক আসার আগ পর্যন্ত রোগী সুস্থ করার অভিনয় করেন রাহেন। লিটন হোসেন বলেন, চম্পার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া (স্ট্রোক) বন্ধ হয়ে গেছে বলে ডাকা হয়। আমি গিয়ে পালস পরীক্ষা করে দেখি মারা গেছে। চম্পাকে তার কক্ষের খাটের ওপরে শোয়ানো অবস্থায় ছিলেন। পায়খানা ও প্রসাব করার কারণে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিলো। তখন সেখানে রাহেন ও তার বড় ভাবি ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। গ্রাম্য চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণার পর চম্পার শরীরের কাপড়-চোপড় ও বেডসিট পরিবর্তন করেন রাহেন। গলায় ওড়না পেচিয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিবেশীদের খবর দেয়।
নিহতের শাশুড়ি বানিয়ারা খাতুন বলেন, রাহেন কি করেছে তা আমি জানি না। প্রতিদিনের ন্যায় ভোর থেকেই রান্না নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। রান্না শেষ করে আমি সকলের ঘুম থেকে ডেকি তুলি। একপর্যায়ে শুনি গলায় ওড়না দিয়ে চম্পার মৃত্যু হয়েছে। আপনার সেবা করার জন্য চম্পাকে বাড়িতে আনা হয়েছে তাহলে আপনি কেন সকালে রান্না করছিলেন? এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি বৃদ্ধা বানিয়ারা। শাশুড়ির সেবা করার জন্য নাকি রাহেনের সেবা করার জন্য চম্পাকে স্বামীর বাড়িতে নেয়া হয়েছিলো সেই মুখরোচক গুঞ্জন গ্রামের মানুষের মাঝে।
এদিকে নিহতের পিতার পরিবার খবর পায় চম্পা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ (স্ট্রোক) করে মারা গেছে। এর আগে তার হৃদযন্ত্রে (হার্টে) সমস্যা ছিলো। ঘটনাস্থলে গিয়ে তারা স্বাভাবিক মৃত্যুও মনে করেছিলেন। কাপড় সরিয়ে চম্পার মুখ দেখতে গিয়ে গলায় ফাঁসের দাগ নজরে আসে। মৃত্যুর নানা কারণ প্রচারের বিষয় নিয়ে পিতার পরিবারের লোকজনের মনে সন্দেহের দানা বেধে ওঠে। বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে হত্যাকা- হয়েছে বলে তারা অনেকটাই নিশ্চিত হন।
খবর পেয়ে গাংনী থানার সেকেন্ড অফিসার মনিরুজ্জামান ও এসএসআই কামরুল হাসান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে মেহেরপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ও গাংনী থানার ওসি আনোয়ার হোসেন ঘটনাস্থলে যান। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে মৃত্যুর কারণ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ সৃষ্টি হয়। তাই মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়। আজ বৃহস্পতিবার মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানায় পুলিশ।
চম্পার পিতা জহির উদ্দীন শাহ বলেন, জামাই বিদেশ থাকার কারণে নাতি ও মেয়ে আমার কাছে থাকতো। তবে শাশুড়িয় সেবা করার কথা বলে দেবর রাহেন তাদের বাড়িতে যেতে চাপ দেন। এ কারণে মাস সাতেক আগে ছেলেকে নিয়ে স্বামীর বাড়িতে যায় চম্পা। রাহেন বাড়ি ফিরে ঘর নির্মাণ সম্পন্ন করার জন্য চম্পার কাছে থাকা নগদ টাকাগুলো নিয়ে নেয়। ধার করেও কিছু টাকা দেয়া হয়। এসব বিষয় নিয়ে রাহেনের সাথে তার বিরোধ চলছিলো। এ বিরোধের জের ধরে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
জানা গেছে, ঘরের ছাউনির চালের বাঁশের সাথে গলায় ফাঁস দেয়ার কথা বলা হলেও বাঁশে ওড়না জড়ানোর কোনো দাগ নেই। দরজাও স্বাভাবিকভাবেই খোলা ছিলো। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ থাকলে দরজা ভাঙার প্রয়োজন হতো। তাহলে চম্পাকে কি পাশবিক নির্যাতন করে শ^াসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে? নাকি শুধু শ^াসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে এমন গুঞ্জন ছিলো উপস্থিত উৎসুক মানুষের মনে। চম্পা ও রাহেন দেবর-ভাবি। কিন্তু সে চম্পাকে স্বামীর মতোই শাসন করতেন। এ নিয়ে চরম আপত্তি জানায় ছেলে চঞ্চল। কিছুদিন আগে মারধরও করেছিলো। অভিমানে চম্পা রেলের চাকার নিচে মাথা দিয়ে মরতে গিয়েছিলেন।
চঞ্চল জানায়, রাত সাড়ে ১২টার দিকে মা অসুস্থ বোধ করছিলো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরে দাদির ঘরে ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরে উঠে পাশে বড় চাচার বাড়িতে পড়তে যাই। তাই রাতে কি হয়েছে আমি জানি না। পরে বড় চাচি গিয়ে মায়ের মৃত্যুর খবর দেয়। আমার চাচা রাহেন বলেন, স্ট্রোক করে তোমার মা মারা গেছে। পরে মায়ের গলায় ফাঁস দেয়ার দাগ দেখতে পাই। তবে রাহেন ও চম্পার মধ্যে বিবাদের বিষয়ে বর্ণনা দেন চম্পার বড় ভাইয়ের ছেলে শামীম হোসেন। তিনি বলেন, ঈদের দুই দিন পর ফুফু (চম্পা) কুষ্টিয়ার মিরপুরের রেললাইনে আত্মহত্যার জন্য গিয়েছিলো। তার ছেলের কাছ থেকে খবর পেয়ে আমি মোটরসাইকেলে খলিশাকু-ি থেকে রওনা দিই। নিমতলায় গিয়ে ফুফুকে আটকায়। তখন পারিবারিক দুঃখের কথা আমাকে বলতে শুরু করে। খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছান রাহেন উদ্দীন ও তার এক সঙ্গী। মোটরসাইকেল থেকে নেমেই ফুফুর গালে চড়-থাপ্পড় মারতে শুরু করেন রাহেন। আমি ঠেকাতে গেলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। একপর্যায়ে জোরপূর্বক তাকে মোটরসাইকেলে চড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে যাই। তখন থেকেই আমাদের পরিবারের সাথে ফুফুর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো। রাহেনের আচরণে অন্য কিছু সন্দেহ হচ্ছিলো। অন্য সম্পর্ক-দ্বন্দ্বের আঁচ পাচ্ছিলাম।
মরদেহ সুরতহাল প্রতিবেদনকারী গাংনী থানার সেকেন্ড অফিসার মনিরুজ্জামান বলেন, গলার দুই পাশে ফাঁস দেয়ার দাগ পাওয়া গেছে। তার সাথে ধস্তাধস্তি হয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, হত্যাকা- বলেই পুলিশের প্রাথমিক ধারণা। নিহতের পিতার পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সন্দেহভাজন একজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রাহেনকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছে পুলিশ।