হজ ও উমরাহ করার সহজ নিয়ম

………………হজের ফরজ তিনটি ১. মিকাত থেকে ইহ্রাম বাঁধা, ২. উকুফে আরাফা বা আরাফায় নির্দিষ্ট সময় অবস্থান ৩. তাওয়াফে জিয়ারত ১০, ১১, ১২ যেকোনো দিন। হজের ওয়াজিব ছয়টি ১. রামি বা মিনার জামারাতে কঙ্কর মারা। ২. হলক বা চুল কামানো বা খাটো করা। ৩. তামাত্তু বা কিরান হজ পালনকারীর কোরবানি দেয়া। ৪. মুজদালিফায় অবস্থান করে এক আজান দুই ইকামতে মাগরিব ও এশার নামাজ একই সাথে পড়া। ৫. সাফা মারওয়া সায়ী করা। ৬. মিকাতের বাইরের হাজিদের বিদায়ী তাওয়াফ করা। এ আমলগুলো না করলে প্রতিটার জন্য আলাদা আলাদা দম কোরবানি দিতে হবে।

হজের সুন্নত ১০টি ১. তাওয়াফে কুদুম (কিরান-ইফরাদ হজে)। ২. তাওয়াফে ইজতেবা ও রমল করা। ৩. ইমামুল হজের তিনটি খুতবা শোনা (৭ তারিখে মক্কায় ৯ তারিখে আরাফায় এবং ১১ তারিখে মিনায়)। ৪. জিলহজের ৮, ১০, ১১, ১২ তারিখে মিনায় রাত যাপন। ৫. মিনায় ফজর আদায় করে ৯ তারিখে সুর্য উঠার পর আরাফাতে যাওয়া। ৬. আরাফাতে গোসল করা। ৭. সূর্যাস্তের পর আরাফাতে মাগরিব না পড়ে মুজদালিফায় যাওয়া। ৮. জিলহজের ৯ তারিখ সেখানে রাত যাপন। ৯. জিলহজের ১০, ১১, ১২ মিনার সীমানায় থাকা। ১০. রামি বা কঙ্কর মারা শেষে মিনা থেকে মক্কা যেতে ‘মুহাসাব’ যা বর্তমানে ‘কুদাই’ নামে পরিচিত সেখানে যাত্রাবিরতি করা।
ইহ্রাম বাঁধা উমরাহর ফরজ দুটি ১. নিয়তসহ ইহ্রাম বাঁধা ২. তাওয়াফ করা। ওয়াজিব দুটি ১. সায়ী করা ২. হলক (মাথা কামানো) বা চুল ছোট করা। হজ-উমরাহর জন্য ফরজ। ইহরাম ছাড়া মিকাত অতিক্রম করলে দম দিতে হয়। হজ বা উমরাহ পালন করতে হলে মিকাত থেকে ইহ্রাম বেঁধে মক্কায় প্রবেশ করতে হয়। আফাকি বা ভিনদেশিদের মিকাত ৫টি। (‘আজুজাকাই’-আলজুহ্ফা-জুলহুলাইফা-জাতেইরক্ব-কারনাল মাঞ্জিল-ইয়্লাামলাম)। ১. ‘আলজুহ্ফা’ (সিরিয়াসহ উত্তর পশ্চিমাঞ্চল থেকে এ পথে আগমনকারীদের জন্য)। ২. ‘জুল হুলাইফা’ মক্কা মোকাররমা থেকে ৪৫০ কিমি. উত্তরে (মদিনাসহ উত্তরাঞ্চল থেকে এ পথে আসা ব্যক্তিদের জন্য)। ৩. ‘জাতে ইর্ক’ মক্কা মোকাররমা থেকে ৯৪ কিমি. উত্তর-পূর্বে (ইরাক ইরানসহ এ পথে আসা হজযাত্রীদের জন্য)। ৪. ‘কারনাল মঞ্জিল’ মক্কা মোকাররমা থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে (উপসাগরীয় অঞ্চলসহ পূর্বাঞ্চলের ব্যক্তিদের জন্য)। ৫. ‘ইয়ালামলাম’ মক্কা মোকাররমা থেকে ৫৪ কিমি. দক্ষিণ-পূর্বে (বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান শ্রীলংকাসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় হজযাত্রীদের।

মনে রাখা দরকার যে দেশের বাসিন্দাই হোক না কেনো যেদিক দিয়ে হজযাত্রা শুরু হবে সে দিকের মিকাতই তার মিকাত ধরে নিতে হবে। যেমন- পশ্চিমা দেশ ইউরোপ আমেরিকার হজযাত্রীরা সাধারণত এশিয়ার কোনো দেশের বিমানবন্দরে ট্রানজিট পেসেঞ্জার হয়ে আসেন তাই তিনি মক্কা হেরেমের যেদিক দিয়ে ট্রানজিট যাত্রা শুরু করবেন সেদিকের কাছের মিকাতকেই তার মিকাত ধরে নিতে হবে তা না হলে দম দিতে হবে।

মক্কিদের (হুদুদে হেরেমের ভেতরে বসবাসকারী) ইহ্রামের স্থান হল হিল্। হিল্ বলা হয় হেরেমের সীমানার বাইরের অংশকে। এখানে বসবাসকারীদের হিল্লি বলা হয়। তারা উমরাহ করতে চাইলে হুদুদে হেরেমের হিল থেকে উমরা ইহ্রাম বাঁধতে হবে। তবে হজের ইহ্রাম মক্কা হেরেম তেকে বাঁধলেই হবে।

মক্কা হেরেমের সীমানা, ১. ‘জিরানা বা জারকানা’ মক্কা হেরেমের পূর্ব দিকে দূরত্ব ১৬ কিমি. গজোয়ায়ে হোনাইনের বিজয়ের পর এখান থেকে নবী (সা.) উমরার ইহ্রাম বেঁধে ছিলেন বলে আহ্নাফ উলামা ছাড়া অন্য উলামারা এখান থেকে উমরার ইহ্রাম বাঁধা উত্তম মনে করেন। তবে হানাফি উলামারা আমলের ক্ষেত্রে ফেলি হাদিসের ওপর কাওলি হাদিসকে প্রাধান্য দেন বলে মক্কি বা হুদুদে হেরেমবাসীর জন্য ‘আয়েশা মসজিদ’ থেকে উমরাহর ইহ্রাম বাঁধাকে উত্তম মনে করেন। তাদের যুক্তি হলো আমলের ক্ষেত্রে মানুষের ব্যক্তিগত অভ্যাস রুচিবোধও জড়িত। যেমন নবী (সা.)-এর ‘সাওমে বেসাল’ বা ইফতার না করে লাগাতার রোজা পালন যা কোনো কোনো সাহাবি করতে চাইলে তিনি নিষেধ করেন। তেমনি তাহাজ্জুদে দীর্ঘ কিয়াম রুকু সেজদা ইত্যাদিতেও তিনি নিরুৎসাহিত করে বলতেন ‘এগুলো তোমাদের স্বাস্থ্যে কুলাবে না আমাকে আল্লাহ বিশেষভাবে খাওয়ান পরান তাই এতে আমার সামর্থ্য আছে তোমাদের নাই’। হানাফিদের উত্তম বলার দ্বিতীয় কারণ হলো, মানুষ তার স্বভাব ও রুচির কারণে যাত্রার শুরু থেকেই প্রয়োজনীয় তৈরি সেরে নেন। হোনায়েন বিজয়ের পর নবী (সা.) কিছু দিন এখানে অবস্থান করে মক্কা যাত্রার শুরুতে সঙ্গী সাথীসহ উমরাহর ইহ্রাম বেঁধে যাত্রা শুরু করেন।

২. ‘হুদাইবিয়া’ মক্কা হেরেমের দক্ষিণে ২৯ কিমি. দূরে অবস্থিত। এখানেই ঐতিহাসিক হুদাইবিয়া সন্ধি হয়েছিলো। ‘লাক্বাদ রাদ্বি আল্লাহু আলাল মু’মিনিনা’ তখন আল্লাহ মুমিনদের ওপর রাজি খুশি হয়ে গেলেন ‘ইজ ইয়ুবাঈয়ুনাকা তাহ্তাশ শাজারাতি’ যখন তারা গাছের নিচে বায়াত বা অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলো এ ঘটনা উল্লেখ করে কোরআনের আয়াত নাজিল হয়ে ওই অঞ্চলকে সম্মানিত করে তোলে। এ সম্মানের কারণে অনেকে সেই গাছের পরিদর্শনে যেতো। এ কারণে হজরত উমর ফারুক (রা.)-এর আমলে তা কেটে ফেলেন।

৩. ‘তানঈম বা মসজিদে আয়েশা’ যা মক্কা হেরেমের উত্তরে ৬ কিমি. দূরে অবস্থিত। এখান থেকে নবী (সা.)-এর নির্দেশে মা আয়েশা ইহ্রাম বেঁধে উমরা পালন করেছেন। প্রাকৃতিক কারণে তিনি নবীজির সঙ্গে জিরানা থেকে ইহ্রাম বাঁধতে পারেননি তাই মক্কা আসার পর তার সমস্যা দূর হয়ে গেলে আয়েশার ভাইয়ের সঙ্গে তানঈম এলাকায় আয়েশাকে উমরাহর ইহ্রাম বাঁধার জন্য পাঠান, তার স্মরণেই সেখানে এখন আয়েশা মসজিদ প্রতিষ্ঠিত। এ কারণেই হানাফি উলামারা বলেন, ‘যারা সঙ্গত কারণে হদ্দে হেরেমে ঢুকে যায় তারা নবীজির কাওলি হাদিস মোতাবেক তানঈম হিল যা বর্তমানে আয়েশা মসজিদ নামে পরিচিত সেখানে গিয়ে উমরাহর ইহ্রাম বাঁধাই উত্তম’। মানুষের সহজাত স্বভাবকে আল্লাহ ও তার রাসূল কখনও বাতিল করেননি। মানুষের স্বভাব হল বাড়ির কাছে তার প্রয়োজনীয় সামান বা সুবিধা থাকলে কষ্ট করে দূরে যায় না। হ্যাঁ কেউ যদি দূরে গিয়ে মনে সুখ পায় তো নিষেধ নেই।

৪. ‘ওয়াদি নাখলা’ মক্কা হেরেম থেকে উত্তর-পূর্বে ১৪ কিমি.। উল্লেখ্য, এগুলো হদ্দে হেরেমের বাইরে প্রসিদ্ধ স্থান। উমরাকারীদের সুবিধার্থে এখানে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। তাই হিলের ভেতরে অবস্থানকারী বা মক্কার হেরেমে অবস্থানকারীদের কাছে যে হিল্ সেখান থেকেই উমরাহর নিয়ত করতে পারেন। হিল্লিদের (হদ্দে হেরেমের বাইরে কিন্তু মিকাতের ভেতরে বসবাসকারী) জন্য সবচেয়ে কাছের হিল্ হল ‘ওয়াদি নাখলা’। মোট কথা এ বাসিন্দারা হুদুদের হেরেমের বাইরে থেকে ইহ্রামের নিয়ত বেঁধে এলেই হবে। যেমন- আরাফাতবাসী আরাফাত থেকে, জেদ্দাবাসী জেদ্দা থেকে, তায়েফবাসী তায়েফ থেকে ইহ্রাম বেঁধে মক্কায় প্রবেশ করবে। কাবা জিয়ারতকারীরা বিনা ইহ্রামে মক্কায় প্রবেশ আদবের খেলাফ। ইহ্রাম বাঁধার নিয়ম শরীরে অবাঞ্ছিত লোম সাফ করে নখ কেটে ভালো করে অজু-গোসল করে ইহ্রামের কাপড় একটি লুঙ্গির মতো পরবে আরেকটি চাদরের মতো গায়ে জড়াবে কাপড় পরা এবং নিয়তের আগে গায়ে আতর খোশবু মাখা সুন্নত কিন্তু নিয়ত করার পর বৈধ নয়। ভুলে লাগালেও দম দিতে হবে। ইহ্রামের কাপড় পরার পর দুই রাকাত ‘সুন্নাতুল ইহ্রাম’ নামাজ মাথা ঢেকে পড়া। এ নামাজটির প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা কাফিরুন বা কুল ইয়া আইয়্যুহাল কাফিরুন দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ইখলাস বা কুল হু আল্লাহু আহাদ পড়া উত্তম। কোনো মসজিদ থেকে নিয়ত করলে তাহিয়্যাতুল মসজিদই সুন্নাতুল ইহ্রামের মর্যাদা পাবে। কেউ বেশি পড়লে আপত্তি নেই। এবার মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে ‘আল্লাহুম্মা উরিদু উমরাতান, আয় আল্লাহ আমি উমরার নিয়ত করছি ওয়া ইয়াসসির হা লি ওয়া তাক্বাব্বাল মিন্নি এবং তা আমার জন্য সহজ করে দাও, আর কবুল করে নাও’। এটি মুখে বলা জরুরি নয়। তবে দিলের প্রশান্তির জন্য বলা উত্তম। স্মরণ রাখা দরকার নিয়তের পর কমপক্ষে তিনবার পুরুষেরা উচ্চস্বরে আর মহিলারা অনুচ্চস্বরে তালবিয়া বা ‘লাব্বায়িক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, লাব্বায়িকা লা শারিকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক্ লা শারিকা লাক’ পড়ে কাবামুখী চলা শুরু করুন। আর তালবিয়া পড়তে থাকুন এখন এটিই আপনার সর্বোত্তম জিকির। বায়তুল্লাহর চিহ্ন দেখা গেলে তালবিয়া পাঠ বন্ধ রেখে ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা খাইরি খালকিহি, আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআসলুকা ওয়ারিদ্বাকা ওয়া জান্নাতা ওয়া নাউজুবিকা মিনান্নারি’ মনে মনে পড়তে থাকুন। আর গেটের দিকে অগ্রসর হোন সামনে যে গেট পড়ে তা দিয়েই মাতাফে নামুন। (তবে বাবুস সাফা বা ২৪ নম্বর গেট দিয়ে ঢোকা সুন্নত) মাতাফ বা তাওয়াফের স্থানে নামার আগে পুরুষরা ডান কাঁধ থেকে চাঁদর নামিয়ে ডান বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধে রাখুন একে ‘ইজতেবা’ বলে। মাতাফে নামার আগে ইজতেবা জায়েজ নয়। এর পর হজরে আসওয়াদের বরাবর গিয়ে ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকরব’ বলে চুমা দিয়ে সম্ভব না হলে দুই হাত উঁচু করে ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার’ বলে তাওয়াফের নিয়ত করে খানায়ে কাবাকে বাম দিকে রেখে তাওয়াফ শুরু করুন। তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে ‘রমল করা’ বা বীরের মতো হাঁটা পুরুষের জন্য সুন্নত। মনে রাখা দরকার মসজিদে হেরেমে তাওয়াফের আগে কোনো নামাজ নয় এই তাওয়াফটিই ‘তাহিয়াতুল মসজিদ’ নামাজের হুকুম রাখে। তাই তাওয়াফ যেন অজু অবস্থায় এবং বিনা শোরগোলে হয়। এ তাওয়াফকে ‘তাওয়াফে তাহিয়া’ বলে।
তাওয়াফ বামদিকে করার রহস্য ইসলামের সব শুভ কাজগুলো ডানদিকে সুন্নত। যেমন রাস্তার ডানে চলা, ডান কাতে শোয়া, নামাজে ডানে সালাম ফিরানো, মসজিদে ডান পায়ে ঢোকা। বায়তুল্লাহর তাওয়াফ বামদিকে কেন? এর রহস্য সম্পর্কে সুফি উলামারা বলেন মানুষের কলব বামদিকে তাই কাবার সাথে যেনো মানুষের আকর্ষণ বাড়ে এজন্য কাবাকে বামদিকে রেখে তাওয়াফ চালু হয়েছে। এর দলিল হিসেবে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর হৃদয় নিংড়ানো মোনাজাতটি উল্লেখ করেন যা সূরা ইবরাহিমে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। ‘রাব্বানা, হে আমার রব ইন্নি আসকান্তু আমি রেখে যাচ্ছি মিন জুররিয়্যাতি আমার সন্তানাদিকে বিওয়াদিন গাইরি জি-জরঈন একটি বিরাণ উপতক্যায়, যেখানে ফসলাদি হয় না, ইনদা বাইতিকাল মোহাররাম, তবে আমার ভরসা হলো এখানে পবিত্র, ঘরের ভিত্তিভূমি আছে, রাব্বানা হে আমার রব লিইয়ুক্বিমুসসালাতা, তাদের নামাজি করে দিও, ফাজআল আফঈদাতাম মিনান্নাসি তাহ্বি ইলাইহিম যাতে করে মানুষের হৃদয়গুলো কাবামুখী হয়ে তাদের দিকে ঝুঁকে যায়, ওয়ারজুক্বহুম মিনাসসামারাতি বিভিন্ন ফলাহার দিয়ে তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করে দিও লাআল্লাকুম তাশকুরুন, যেনো তারা তোমার শোকরিয়া করতে পারে। এ আয়াতে ‘আফইদাতুন’ শব্দটি ‘ফুয়াদ’-এর বহুবচন, যার বাংলা হৃদয় বা কলব। যেমন গীতিকবিতায় আছে ‘কলবে উঠিলে ধ্বনী জারি হয় এলমে লুধুনি’। ইতিহাস সাক্ষী এ দোয়ার প্রতিটি কথা আল্লাহ এমনভাবে কবুল করেছেন যে একবার কাবার তাওয়াফ করে এসেছে তার মনে চায় বারবার যেতে, এখানে অদৃশ্য খোদাই চৌম্বুক শক্তি কাজ করছে। সারা দুনিয়ার সেরা ফলফলাদি মক্কার বাজারে সারা বছর পাওয়া যায়। আর আওলাদে ইবরাহিমের সোনালি নক্ষত্র নবীয়ে দোজাহাঁ এমন নামাজি ছিলেন তিনি বলতেন কোররাতু আইনি ফিসসালাত, নামাজ আমার চোখে প্রশান্তি এনে দেয়। আর তার উম্মতের মাধ্যমেই নামাজের সরাসরি কাবা আবাদ করে রেখেছেন।

তাওয়াফ পাঁচ প্রকার, ১. তাওয়াফে কুদুম, যা ইফরাদ ও কিরান হজকারীরা করে থাকেন। ২. তাওয়াফে তাহিয়া, যা উমরাহ পালনকারীরা করে থাকেন। ৩. তাওয়াফে জিয়ারত, যা প্রত্যেক হজকারীর জন্য ফরজ, তবে কেউ তাওয়াফে কুদুম করে থাকলে তার জন্য ফরজ নয়।
৪. তাওয়াফে নফল’ ইহ্রাম ছাড়া যে তাওয়াফ করা হয়। ৫. তাওয়াফে বিদা’ আফাকি বা মক্কার বাইরের লোকেরা তাওয়াফে বিদা করে মক্কা থেকে বিদায় নিতে যে তাওয়াফ করে থাকেন।
তাওয়াফের মাসনুন দোয়া- ‘সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদু লিল্লাহ আল্লাহু আকবার’ এই সহজ তাসবিহই নবী (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন, কারণ তার উম্মতের মধ্যে অনেক অনারব সাধারণ মানুষও আসবে যারা বড় কোনো দোয়া পাঠ করতে পারবে না। তাই এই ছোট এবং সহজ তাসবিহ্ শিক্ষা দিয়েছেন। সোনারগাঁ পরগণার হাদি মুবাল্লিগে ইসলাম মাওলানা লালপুরীর কাছে কেউ কোনো দোয়া অজিফা চাইলে এমন ছোট ছোট দোয়া অজিফাই দিয়ে দিতেন। এটাও না পারলে বলতেন শেষ রাতে উঠে সেজদা দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলবে শোনো গো মাবুদ আমারই কথা/তুমি জানো হৃদয় ব্যথা’।
অথবা কেউ বাড়িয়ে পড়তে চাইলে ‘সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। ওয়া লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ’। অথবা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াদাহু লা শারিকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাঈইয়িন কাদির’। বুজুর্গানে দ্বীন বলেন, এসব ছোট ছোট তাসবিহ্গুলো যা নবী (সা.) পড়েছেন তা অন্যান্য জিকির তাসবিহ থেকে উত্তম। হ্যাঁ তবে কেউ পড়তে চাইলে অন্যকিছু পড়তে পারে। মানা নেই প্রেমিক প্রেমাস্পদের ঘরে কী হাদিয়া পেশ করবে তাতে অন্যের বলার কী আছে? যেমন মূসা (আ.)-এর জমানায় এক মরু রাখাল পশুকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে সুর করে নাশিদ (কাসিদা-সঙ্গীত-গান) গাইছে যার অর্থ এমন, আয় আল্লাহ তোমাকে আমি এত ভালোবাসি যদি কাছে পাইতাম তোমার হাতে পায়ে তেল মেখে খেদমত করতাম। তোমাকে বুকে জাপটে রাখতাম। এ কথা শুনে মূসা (আ.) বলেন, ‘রে বোকা আল্লাহর কী হাত পা শরীর আছে যে তুমি তাকে তেল মেখে আদর করে বুকে জড়িয়ে রাখবে? তিনি তো নিরাকার মহান সত্তা’। এ কথা শোনার পর রাখাল চুপ হয়ে গেলে আল্লাহ মুসা (আ.) কে ডেকে বলেন, ‘হে মূসা তার ভালোবাসার কথাগুলো আমার খুবই পছন্দের ছিলো তুমি সেখানে বাধা দিতে এলে কেন? এ জন্য কবি শেখ সাদী বলেছেন গুফেত আশেকোঁ মাশুক কেহ্ রাঞ্জিস্ত/কেরামান কাতেবিন রা হাম খবর নিস্ত (আশেক ও মাশুকের মধ্যে যে শব্দহীন কথাবার্তা চলে তার খবর কেরামান কাতেবিন ফেরেশতাও জানে না।) এভাবে তাসবিহ পড়তে পড়তে রুকনে ইয়ামেনি বরাবর গেলে সম্ভব হলে তা স্পর্শ করে না হলে ইশারা করে ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানা, ওয়াকিনা আজাবান্নারি ওয়াদ খিলনাল জান্নাতা মাআল আবরার, ইয়া আজিজু ইয়া গাফফার ইয়া কারিমু ইয়া সাত্তার ইয়া রাব্বাল আলামিন’। এ দোয়া পড়তে পড়তে হজরে আসওয়াদের দিকে অসগ্রসর হলে এক চক্কর পুরা হবে। এটি নবীজির পঠিত দোয়া। এভাবে লাগাতার সাত চক্কর পুরা করে মাকামে ইবরাহিম সামনে রেখে মাকরুহ্ সময় না হলে দুই রাকাত ওয়াজিবুত্ তাওয়াফ নামাজ আদায় করে মুলতাজামে বুক লাগিয়ে না পারলে বরাবর হাত উঁচু করে দোয়া করা। এখানে দোয়া কবুল হয় বলে শ্রুতি আছে। এরপর জমজম কূপের পানি রক্ষিত পাত্রের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে-বসে তিন চুমুকে বিসমিল্লাহ বলে পানি পান করুন। ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিয়ান রিজক্বান ওয়াসিয়ান ওয়া শাফাআম মিন কুল্লি দাঈন’। এ মোনাজাতও করতে পারেন। জমজম পানকালে দোয়া কবুল হয় বলে শ্রুতি আছে। সায়ী করা ওয়াজিব এরপর ‘ইন্নাসসাফা ওয়াল মারওয়াতা’ বলতে বলতে সাফা পাহাড়ে উঠে কিবলার দিকে মুখ করে আল্লাহু আকবার বলে মারওয়ার দিকে অগ্রসর হওয়া সবুজ লাইট চিহ্নিত স্থানে পুরুষেরা দৌড়ে হাঁটা। নারীরা স্বাভাবিকভাবে হাঁটা আর মনে মনে ‘রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আন্তা আজজাল আকরাম’ এ দোয়া বা যে কোনো দোয়া করা। মারওয়ায় গেলে সায়ীর এক চক্কর শেষ হবে আবার কাবামুখী হয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে মারওয়া থেকে সাফার দিকে আসা। এবার দুই চক্কর হলো এভাবে সাত চক্কর দিয়ে সায়ী শেষ করে মারওয়ায় কিছুক্ষণ অবস্থান করে মনে মনে দোয়া করা ইচ্ছা হলে দু’রাকাত নামাজ পড়ে মাথা কামিয়ে মহিলারা সব চুলের অগ্রভাগ যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণ কেটে হালাল হয়ে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে মারওয়া পাহাড়ের আশপাশে পেশাদার হাজাম বা হালাল ব্যক্তির মাধ্যমে হালাল হওয়া উত্তম।
মনে রাখা দরকার তাওয়াফ বা সায়ীর সময় নামাজ শুরু হলে জামাতে শরিক হয়ে নামাজ আদায় করে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে যেখানে নামাজে দাঁড়াবে সেখান থেকেই বাকি তাওয়াফ বা সায়ীটুকু শেষ করতে হবে নতুবা সাত তাওয়াফ বা সায়ী পূর্ণ হবে না। তাই সতর্কতা হয়ে একটি চক্কর বাড়িয়ে তাওয়াফ বা সায়ী শেষ করলে ভালো হয়। মক্কায় অবস্থানকালে একাধিক উমরাহ করা
আফাকি বা বিদেশিরা অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে হজ করতে যান। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব বিদায়কালে খানায়ে কাবায় গিয়ে তাদের জন্য দোয়া করতে বলেন, অনেকে রাহা খরচও দেন তাদের মুরব্বিদের জন্য। উমরাহ করে ইসালে সাওয়াব বা সাওয়াব বকশিশ করা উত্তম। এতে মনে প্রশান্তিও আসে যে আসার সময় ওমুকে আমায় কিছু খরচপাতি দিয়েছে। তাই তার মুরব্বিদের নামে উমরাহ করে হক আদায় করে দিলাম। হ্যাঁ স্বাস্থ্যে না কুলালে তাদের জন্য নফল তাওয়াফও করতে পারেন। হোনায়েন বিজয়ের পর নবীজি যে উমরাহ করেছিলেন এরপর তিনি মক্কায় কিছু দিন অবস্থান করলেও আর উমরাহ করেননি, তাই অনেক উলামা বলেন, যেহেতু নবীজি হিলে গিয়ে ইহ্রাম বেঁধে উমরাহ না করে বেশি বেশি তাওয়াফ করেছেন তাই শুধু তাওয়াফই উত্তম। হানাফিরা বলেন, এটি আরববাসীর জন্য হতে পারে, কিন্তু আফাকি বা বিদেশিরা তো বারবার মক্কা আসার সুযোগ পায় না তাই তারা করলে নিরুৎসাহিত করা যাবে না। কারণ নবী (সা.) তো একাধিক উমরাহ করতে নিষেধ করেননি। মক্কায় থাকা অবস্থায় হজের আগে বা পরে বিদেশি হাজি বিশেষ করে এশিয়ার পূর্বাঞ্চলের হাজিরা একাধিক উমরাহ করে থাকে। এটা কেউ করতে চাইলে নিষেধ করা উচিত নয়, কারণ এতে হাজিরা মানসিক প্রশান্তি পায় এবং মক্কা হেরেমের আশপাশের প্রবাসী শ্রমিকরা (যেমন ড্রাইভার, হাজ্জাম) বাড়তি আয়ের সুযোগ পায়। মানুষকে সরাসরি দান করার চেয়ে পেশাভিত্তিক মজুরি দিলে মানুষের সৃষ্টিগত সম্মান বজায় থাকে আল্লাহও এতে বেশি খুশি হন।
সাওয়াব এবং ফজিলতের কাজে খায়রুল কুরুনের কোনো অনুমোদন থাকলেই তা আমলযোগ। এটাই আহলে সুন্নাহর রায়। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি ঠিক নয়। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যেদিন কাফেলা নিয়ে আয়েশা মসজিদে ইহ্রাম বেঁধে উমরা করেছি সেদিনের বাকি এবাদতে কী প্রশান্তি পেয়েছি তা ভাষায় ব্যক্ত করা যাবে না। এ জন্য আমি বলি যারা যেখানেই যাবেন সফরসঙ্গীরা যদি হামখেয়াল বা একই চিন্তা একই রুচিবোধের না হয় তা হলে সেই সফরের প্রশান্তি আর আনন্দ মাটি হয়ে যায়। হজ উমরাহ এবং শিক্ষাসফরগুলোতে এ বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। আল্লাহ আমাদের হজযাত্রাকে সহজ করে দিন। আমিন।