এইচএসসিতে ফল চ্যালেঞ্জের রেকর্ড

 

স্টাফ রিপোর্টার: সদ্য প্রকাশিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে খাতা চ্যালেঞ্জের রেকর্ড হয়েছে। চলতি বছর ১০টি শিক্ষাবোর্ডে প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থী প্রায় ৩ লাখ পত্রের প্রাপ্ত নম্বর পরিবর্তন করার জন্য আবেদন করেছেন। যদিও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর নম্বর পরিবর্তন হবে না বলে জানিয়েছেন বোর্ড কর্মকর্তারা। গত বছরের তুলনার এবার আবেদনকারীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার। আর পত্রের সংখ্যা বেড়েছে ৪৩ হাজারের বেশি। ১০টি শিক্ষাবোর্ড থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এত সংখ্যাক শিক্ষার্থীর খাতা চ্যালেঞ্জকে পাবলিক পরীক্ষায় খাতা মূল্যায়নের প্রতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনাস্থা বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। আগামী ২২শে আগস্ট এই পুনঃনিরীক্ষণের ফল প্রকাশ করবে আন্তঃ শিক্ষাবোর্ড। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডে। এই বোর্ডে ৪৭ হাজার ৭০০ শিক্ষার্থী ১ লাখ ৩৩২০০ খাতার ফল পরিবর্তন করার আবেদন করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে ইংরেজিতে। ইংরেজির দুটি পত্রের আবেদনের সংখ্যা ১২৩২৫ জন। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড। এবার চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে উচ্চ মাধ্যমিকে ১৪ হাজার ৯৪৯ পরীক্ষার্থী ফল পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করেছেন। বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মাহবুব হাসান বলেন, ১৩টি বিষয়ে ফল পুনঃনিরীক্ষণের জন্য এসব পরীক্ষার্থী আবেদন করেছেন। এরমধ্যে ইংরেজি প্রথমপত্রে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৪৮৮টি খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন এসেছে। এছাড়া বাংলা প্রথমপত্রে ৩ হাজার ৬৮০, দ্বিতীয়পত্রে ২ হাজার ৭৮০, ইংরেজি প্রথমপত্রে ৬ হাজার ৪৮৮, দ্বিতীয়পত্রে ৫ হাজার ২১১, পদার্থ বিজ্ঞান প্রথমপত্রে ৩ হাজার ৬৭, দ্বিতীয়পত্রে ২ হাজার ৩০২, রসায়ন প্রথমপত্রে ১ হাজার ৮৯৬, রসায়ন দ্বিতীয়পত্রে ২ হাজার ১২০, জীববিজ্ঞান প্রথমপত্রে ২ হাজার ২১৯, দ্বিতীয়পত্রে ২ হাজার ৪০, উচ্চতর গণিত প্রথমপত্রে ২ হাজার ২৯৩, দ্বিতীয়পত্রে এক হাজার ৮৫২ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে ৪ হাজার ১৭৮টি খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন হয়েছে। সিলেট শিক্ষাবোর্ডে ৬ হাজার ১২৬ জন আবেদনকারী ১৭ হাজার ৬৯৪টি পত্রের ফল পরিবর্তন করতে আবেদন করেছেন। এর মধ্যে ইংরেজি প্রথম পত্রের ২৪৮৩, ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রে ২১৩০, বাংলা প্রথম পত্রে ১২৫৪, দ্বিতীয় পত্রে ১০২৫ এবং আইসিটিতে ১৪৪৯টি আবেদন পড়েছে। বরিশাল শিক্ষাবোর্ডে ১২ হাজার ৩১৪ জন আবেদনকারী ৩৬ হাজার ৪১৩টি পত্রের জন্য আবেদন করেছে। এই বোর্ডে আবেদনের শীর্ষে রয়েছে ইংরেজি। দুটি পত্রের মোট আবেদন পড়েছে ১১ হাজারের বেশি। রাজশাহীতে পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছে ১২,২৭০ জন শিক্ষার্থী। তারা মোট ৩১ হাজার ২৪৫টি পত্রের আবেদন করেছে। এই বোর্ডে ইংরেজিতে আবেদন পড়েছে ১২ হাজার ৩৪৪টি। যশোর বোর্ডে মোট ২৩৪৬৬টি পত্রের নম্বর বদলের জন্য আবেদন করেছে ১১ হাজার ২৩১জন শিক্ষার্থী। সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে ইংরেজিতে ৩ হাজার ৭৪৪টি। দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডে পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছে ১০ হাজার ৪৬ জন শিক্ষার্থী। তারা মোট ২১ হাজার ২৬টি পত্রের আবেদন করেছে। এই বোর্ডে ইংরেজিতে আবেদন পড়েছে ২৬৪৪টি। এবার সবচেয়ে খারাপ ফল করা কুমিল্লা বোর্ডের  আবেদনের হিড়িক পড়েছে। পুনঃনিরীক্ষণের জন্য এই বোর্ডে আবেদন করেছে ১২০৭০ জন শিক্ষার্থী। তারা মোট ৩৩ হাজার ৭৩৩টি পত্রের আবেদন করেছে। এই বোর্ডে ইংরেজিতে আবেদন পড়েছে ১২ হাজার ৯৭০টি। আইসিটিতে আবেদন পড়েছে ২৮১৫টি। মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডে মোট ১৪ হাজার ৯১৭ জন আবেদনকারী ৪৮ হাজারের বেশি বেশি পত্রের ফল পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেছে। আর কারিগরি শিক্ষাবোর্ডে ১০২৪৩ জন আবেদনকারী ২১ হাজারের বেশি পত্রের ফল পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেছে।

আবেদনের রেকর্ড হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে আন্তঃবোর্ড ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলেন, গত বছর থেকে শিক্ষার্থীরা জিপিএ দেখার পাশাপাশি নম্বরও দেখতে পারছে। আগে কোনো বিষয়ে কত নম্বর পেয়েছে তা জানতে পারতো না। এখন পত্র এবং সিকিউ, এমসিকিউর আলাদা আলাদা নম্বর দেখতে পারছে। তার মতে সবচেয়ে বেশি আবেদন করেছে পরবর্তী গ্রেডের কাছাকাছি নম্বর পাওয়ার শিক্ষার্থীরা। যেমন কেউ যদি ৭৮ বা ৭৯ বা দুটি পত্র মিলিয়ে ১৫৮ পেয়েছে তারাই ফল পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেছে। তাদের ধারণা হয়তো নম্বর পরিবর্তন হয়ে যাবে।

বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, পুনঃনিরীক্ষণে মূল্যায়ন হওয়ার খাতার মোট ৪টি দিক দেখা হয়। এগুলো হলো উত্তরপত্রে সব প্রশ্নের সঠিকভাবে নম্বর দেয়া হয়েছে কি না, প্রাপ্ত নম্বর গণনা ঠিক রয়েছে কি না, প্রাপ্ত নম্বর ওএমআর শিটে উঠানো হয়েছে কি না, এবং প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী ওএমআর শিটে বৃত্ত ভরাট ঠিক আছে কি না। এসব বিষয় পরীক্ষা করেই পুনঃনিরীক্ষার ফল দেয়া হয়েছে বলে বোর্ড কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তার মানে কোনো শিক্ষার্থীর খাতা পুনরায় মূল্যায়ন হয় না।

জানা গেছে, কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে পরীক্ষকের অবহেলার কারণে শিক্ষার্থীরা ফল বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। এতে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, এমনকি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু যাদের কারণে এই বিপর্যয়, দায়ী সেই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয় না। এতে অন্য পরীক্ষকরাও সতর্ক হচ্ছেন না। ফলে প্রতিবছর বাড়ছে ভুলের হার। সম্প্রতি আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের তদন্তেও পরীক্ষকদের ভুলের বিষয়টি উঠে এসেছে। গত বছর ময়মনসিংহে একজন পরীক্ষক খাতা মূল্যায়ণ না করেই বিজ্ঞানের ৬০০ খাতায় মনগড়া নম্বর দেয়। এতে কপাল পুড়েছে ৬০০ শিক্ষার্থীর। পরে বোর্ড তদন্ত করে এ মহা কেলেঙ্কারির প্রমাণ পায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। পরে ওই পরীক্ষক ও তার নিরীক্ষককে বোর্ডের সকল কার্যত্রুম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করে। ২০১৫ সালে বরিশাল বোর্ডে এসএসসির হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে অনেক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়। তাদের মধ্যে সনজিত ঘোষ হৃদয় নামে এক পরীক্ষার্থী ছিল। ঘোষিত ফল অনুযায়ী, বরিশাল মহানগরের উদয়ন স্কুল থেকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া হৃদয় চার বিষয়ে জিপিএ ৫ পেলেও হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছিল। বিপর্যয় সামলাতে না পেরে সেদিন দুপুরে আত্মহত্যা করে সে। ঘটনার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বোর্ড কর্তৃপক্ষ ফল পুনর্মূল্যায়ন করে। তাতে দেখা যায়, ভুল বোর্ডেরই। ‘খ’ সেটের খাতা মূল্যায়ন হয়েছিল ‘গ’ সেট দিয়ে। পরবর্তীতে পুনর্মূল্যায়নে হিন্দু ধর্মে জিপিএ ৫ পায় হৃদয়। এ ছাড়া রদবদল হয় এক হাজার ৯৯৪ জনের ফল। ফল বিপর্যয়ের বিষয়টি তদন্তে দুই পরীক্ষক বরিশাল মহানগরের ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক জুরান চন্দ্র চক্রবর্তী ও বরগুনার বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষক বীরেন চক্রবর্তীর দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পায়। কমিটির সুপারিশ অনুসারে তাদের এমপিও (বেতনের সরকারি অংশ) স্থগিত করা হয় এবং সব পরীক্ষার কার্যক্রম থেকে বাদ দেয়া হয়।