শুরুতেই শেষ হতে চলেছে আস্থা অর্জনের চ্যালেঞ্জ

 

স্টাফ রিপোর্টার: আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নের শুরুতেই নিজেদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিশিষ্ট নাগরিকদের সাথে অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের সংলাপের পরই জনআস্থা অর্জনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ শুরু করা কেএম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন এই কমিশনের ব্যাঘ্রকণ্ঠ ম্রিয়মাণ হতে চলেছে। সেই সাথে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অবাধ, সুষ্ঠু ও সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের গৃহীত নানা পদক্ষেপ। বিশেষ করে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে আইনে সংশোধনী এনে প্রচলিত জনসংখ্যা ও প্রশাসনিক অখণ্ডতার পাশাপাশি ভোটার সংখ্যা ও আসনওয়ারী সীমানার আয়তন যোগ করে যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের উদ্যোগ থমকে যাচ্ছে। পুরনো সীমানাতেই এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে ইসি। এর ফলে ইসির অতি গুরুত্বপূর্ণ ৭ এজেন্ডার অন্যতম এই এজেন্ডাটি বাস্তবায়নের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো, কমিশনের সাম্প্রতিক ধীরে চলো নীতির কারণে সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এতে ১-১১ কমিশনের বিন্যাস করা সীমানা বহাল থাকার সম্ভাবনাই জোরালো হয়ে উঠেছে। কমিশনের এই সিদ্ধান্তের কারণে সুবিধাজনক অবস্থানেই থাকছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একইভাবে, আগের মতোই উপেক্ষিত হবে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইসির নতুন সীমানা বিন্যাস সংক্রান্ত সংশোধনী আইন ও বিধিমালার খসড়ায় সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত কাজের পরিধির ৫(২) ক ও খ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদের আসনসমূহ ভোটার সংখ্যা এবং জনসংখ্যার কোটার ভিত্তিতে প্রথমে জেলা পর্যায়ে বণ্টন এবং পরে জেলাসমূহে বরাদ্দকৃত সংসদের আসনসমূহের সীমানা পুননির্ধারণ। সর্বশেষ আদম শুমারি প্রতিবেদনে জনসংখ্যা বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশের অনুর্ধ্ব ১২ মাসের মধ্যে সীমানা পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত কাজ শেষ করতে হবে বলা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে আসন বণ্টনে বলা হয়েছে, প্রতিটি জেলায় ন্যূনপক্ষে একটি আসন এবং প্রতিটি সিটিতে ন্যূনতম একটি আসন এবং বিধি প্রণয়ন করে সিটির আসন সংখ্যা নির্ধারণ হবে। সীমানা বিন্যাস করার পর কমিশনের কাজকর্মের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালত বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

অপরদিকে, বিধির ৩ ধারায় বলা হয়েছে, একাধিক জেলায় অবস্থিত ভূখণ্ড সমন্বয়ে কোনো আসন নির্ধারণ করা যাবে না, প্রতিটি জেলায় ন্যূনপক্ষে একটি আসন নির্ধারণ করতে হবে, নির্বাচনী এলাকার বর্তমান সীমানা যতদুর সম্ভব বহাল রাখা, ইউনিয়ন/উপজেলা/সিটি ও পৌরসভার ওয়ার্ড একাধিক আসনের মধ্যে বিভাজন না করা, প্রশাসনিক সুবিধা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখা।

সূত্র জানায়, এসব আইন ও বিধির খসড়া প্রণয়নের পর জটিলতার মুখে পড়ে কমিশন। ক্ষমতাসীনদের চাপের মুখে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ৩শ’ সংসদীয় আসনের সীমানা বিন্যাস আইন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সংসদের বাইরে থাকা দল বিএনপির অবস্থান বিপরীত মেরুতে। নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় হওয়ার কারণে বিদ্যমান সীমানাতে আস্থা আওয়ামী লীগের। একইভাবে, ২০০৮ সালের আগের সীমানায় ফিরে গেলে ভোটে লাভবান হবে বিএনপি, এ কারণে পুরনো সীমানাতেই ফিরতে চায় দলটি। ইতোমধ্যে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ কমিশনের সাতে সাক্ষাত করে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে এসেছে। তাই ধরেই নেয়া যায়, আসন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপে সীমানা বিন্যাস ইস্যুতে উত্তপ্ত হতে পারে।

সূত্রমতে, ১-১১ এটিএম শামসুল হুদা কমিশনের বিন্যাস করা সীমানাতেই আস্থা আওয়ামী লীগের। সীমানা পুনর্বিন্যাস আইন প্রণয়নের পর ২০০৮ সালেই প্রথম সংসদীয় আসনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৩৩টিতে পরিবর্তন এনে সংসদীয় আসনকে ভেঙে চুরমার করা হয়। এ নিয়ে বিএনপির তখনকার অভিযোগ আমলে নেয়নি সাবেক কমিশন। এমনকি বিদ্যমান সীমানা বিন্যাস আইনে ক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতে গেলেও প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ কম। ফলে সে সময়কার বিন্যাস করা আইনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক সুবিধা হলেও ক্ষতির মুখে পড়তে হয় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের। ফলে সীমানা পরবর্তী নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বিএনপির প্রভাবশালী ও হেভিওয়েট প্রার্থীরা ধরাশাহী হয় এবং বিএনপির দুর্গ বলে পরিচিত মানিকগঞ্জ, নোয়াখালীসহ অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়। ২০০৮ সালের সীমানা বিন্যাস পদ্ধতির কঠোর সমালোচক ছিলেন বিএনপিবিহীন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করা কাজী রকিবউদ্দীন কমিশনও। বিতর্কিত এই সীমানা বিন্যাসের কারণে এই কমিশনও সীমানা বিন্যাস না করেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন সম্পন্ন করে।

এদিকে ইসি সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যমান সীমানা আইনে সংশোধনী আনা এবং তার আলোকে বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়ার পর দেখতে পায় কাজটি কঠিন ও দুর্বোধ্য। মাঝপথে এসে বোধদয় হওয়ার কারণে সীমানা পুনর্বিন্যাস আইনের বদলে নির্বাচনী আইন সংস্কারের দিকে বেশি মনোযোগী এখন কমিশন। যে কারণে গত ৩১ জুলাই সুশীল সমাজের সাথে অনুষ্ঠেয় সংলাপে সংসদ ভেঙে নির্বাচন করা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা, না ভোটের বিধান ফিরিয়ে আনা এবং সহায়ক সরকার নিয়ে তারা যতটা সোচ্চার ছিলেন, ঠিক উল্টো ছিলেন সীমানা বিন্যাস আইনে সংশোধনী আনার ক্ষেত্রে।

এ বিষয়ে সীমানা বিন্যাস সংক্রান্ত কমিটির আহ্বায়ক ও নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সীমানা বিন্যাস আইনটি সংশোধন করতে গিয়ে দেখা গেছে এটি সহজ কোনো বিষয় নয়। অনেক জটিল এবং কঠিন কাজ। কারণ এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। ২০১১ সালে সীমানা আইনের সংশোধনী সংক্রান্ত প্রণীত খসড়ার মধ্যেই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের আইনে কি ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করে এই কাজটি করা হয় তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, সীমানা বিন্যাস আইনে সংশোধনী না আনা হলে পুরনো আইনের আলোকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার বিবেচনায় দু-একটি সীমানাতে পরিবর্তন আনা হতে পারে।