প্রসঙ্গ : অবৈধযানের অবৈধ আনাড়ি চালক

শ্যালোইঞ্জিনচালিত নানা কিছিমের হরেক নামের অবৈধযানের অধিক্য এখন এতোটাই যে, তা সড়ক থেকে উচ্ছেদ করা প্রশাসনের পক্ষে বেশ কঠিন। প্রধান প্রধান সড়কে কোনোভাবে অবৈধযান চলতে দেয় যাবে না, চালালেই অনমনীয় দৃষ্টিতে আইন প্রয়োগ করা হবে। বৈঠকে এ ঘোষণার পরও বন্ধ হয়নি, বরঞ্চ সড়কের ধারেই অবৈধযান কারখানায় দেদারছে তা তৈরি হচ্ছে। প্রতিনিয়তই বাড়ছে অবৈধযানের সংখ্যা, ঘটছে দুর্ঘটনা। শুধু কি প্রাণহানি? শ্যালোইঞ্জিনচালিত হরেক নামের অবৈধযানের কারণে সমাজে ভয়াবহ আকারে পঙ্গুত্বের অভিশপ্ত জীবনের সংখ্যা বেড়েছে। পরিসংখ্যান না থাকলেও হাসপাতাল ও সমাজের বিভিন্ন সূত্রের দেয়া তথ্যমতে, অবৈধযান যতোগুলো মানুষের কর্মসংস্থানের যোগান হয়েছে, যতোটা পরিবার সচ্ছতা পেয়েছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ পঙ্গু হয়েছে, পঙ্গুত্বের বোঝা বহন করা পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। এরপরও সমাজের বাস্তবতার অজুহাতে আইন প্রয়োগে পদে পদে নমনীয়তায় ফুটে ওঠে। এর মাঝে অবৈধযানের অবৈধ আনাড়ি চালকের কারণে অঙ্গহানি হলে অনিচ্ছাকৃত হত্যা চেষ্টা এবং প্রাণহানির হলে অনিচ্ছাকৃত হত্যা মামলা রুজু করে ঘাতক যানের চালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিচারের মুখোমুখি করার উদ্যোগ সমাজের জন্য ইতিবাচক। কল্যাণকর এ পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে। যদিও মামলার ভবিষ্যত কোন দিকে মোড় নেবে তা এখনই বলা কঠিন। অপরাধীর অপরাধের মাত্রা অনুপাতে আইনের দৃষ্টিতে উপযুক্ত শাস্তি অবশ্যই অপরাধপ্রবণতা রোধে সহায়ক হবে।
কৃষিকাজের জন্য বিশেষ করে সেচ কাজের জন্যই বিদেশ থেকে ডিজেল চালিত ইঞ্জিন স্বপ্ল শুল্কে আমদানি করা হয়। কয়েক দশক আগে থেকে দেদারছে আমদানি করা এ ইঞ্জিনের বহুবিধ ব্যবহার শুরুতে প্রশংসিত হলেও যানবহনের ক্ষেত্রে সুফলের তুলনায় ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দেয়ায় মন্ত্রণালয় থেকে তা অবৈধ ঘোষণা করে পরিপত্র জারি করা হয়। সড়ক থেকে অবৈধযান উচ্ছেদের মূল দায়িত্ব দেয়া হয় মূলত প্রশাসনের ওপরই। পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে প্রশাসন আইন প্রয়োগ করবে- এটাই দস্তুর। বাস্তবে তেমনটির বদলে প্রধান প্রধান সড়ক থেকে অবৈধযান উচ্ছেদে মাঝে মাঝে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তা ঝিমিয়ে পড়ে। ফলে অবৈধযান যেন অপ্রতিরোধ্য হয় ওঠে। পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ তাদের স্বার্থের বিষয়টি মেলে ধরে অবৈধযান বন্ধের দাবি জানিয়ে বছরে অন্তত দু একবার আন্দোলনও করে। তাতে যাত্রী সাধরণের দু-একদিনের দুর্ভোগ পোয়াতে হয়। অল্প বিস্তার অবৈধযান মালিক চালকদের ক্ষতির শিকার হতে হয়। তারপর আবারও ফেরে পূর্বের অবস্থায়। চেনা এ দৃশ্য যখন এলাকাবাসীর কাছে গাসওয়া ঠিক তখনই চুয়াডাঙ্গায় জেলা প্রশাসক হিসেবে একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। আইন প্রয়োগে অনমনীয় মানসিকতা লালন করে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধনে নবাগত পুলিশ সুপারও পদে পদে দায়িত্বশীলতারই পরিচয় দিচ্ছেন। এরই প্রতিফলন, অবৈধযানের অবৈধ আনাড়ি চালকের হাতে প্রাণহানি হলেই হত্যা মামলা। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার পল্লি গোপী বল্লভপুর গ্রামে পরশু আলমসাধুর চাকায় পিষ্ট হয়ে এক শিশুর প্রাণহানির পর তা অনিচ্ছাকৃত হত্যা মামলা নিয়ে পুলিশ দায়িত্বশীলতারই পরিচয় দিয়েছে। যা এতোদিন হতো না বললেই চলে। পুলিশের আচরণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার আপসের পথেই হাঁটতেন, নামকাওয়াস্তে ক্ষতিপূরণ নিয়ে মামলা না করে আপসনামায় স্বাক্ষর দিতেন। এর মাঝে পুলিশের নামেও আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের উৎকোচ।
অনিয়ম তখনই নিয়মে রূপান্তর হয়, যখন নিয়ম প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিতদের মধ্যেও কোনো কারণে নমনীয়তা বা উদাসীনতা পেয়ে বসে। আমাদের সমাজে শ্যালোইঞ্জিনচালিত অবৈধযান বন্ধে মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র জারির কিছুদিন অনমনীয়তা পরিলক্ষিত হলেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বহুলাংশে উদাসীন করে তোলে। কারণ হিসেবে সামনে যখন সন্ত্রাসকবলিত জনপদে কর্মসংস্থানের সঙ্কট এবং কৃষিপণ্য স্বস্তায় সহজেই বিক্রির জন্য হাট-বাজারে নেয়ার বিষয়টি মেলে ধরা হয়। কৃষকের উৎপাদিত সবজি যখন মাঠ থেকে ব্যাপারী কেনেন তখন যে মূল্য দেয়া হয়, সেই একই পণ্য কৃষক যখন হাটে নিতে সক্ষম হন তখন পান দ্বিগুণ মূল্য। কৃষক যখন লাভবান হন, তখন কৃষিকাজে উদ্বুব্ধ হন কৃষক। কৃষিপ্রধান দেশ এগিয়ে যায় স্বনির্ভরতার দিকে। একদিকে কর্মসংস্থানের জোগান, অন্যদিকে কৃষককূলের কল্যাণ। ফলে অবৈধযানও অঘোষিত বৈধতা পেতে শুরু করে। মাঝে মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াতে থাকে বৈধ যানের মালিক শ্রমিকরা। আর দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, অঙ্গহানির ঘটনা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেলেও পুলিশের তরফে তেমন কোনো মামলার উদ্যোগ না নেয়ার কারণে অবৈধযান চালকরাও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। গ্রামবাংলায় বেড়েই চলেছে, পঙ্গুত্বের বোঝা। এর মাঝে চুয়াডাঙ্গা পুলিশের পদক্ষেপ আশার আলো দেখাচ্ছে বটে। আর কিছু না হোক, দুর্ঘটনা হ্রাসে অবৈধযান চালকরা এতে কিছুটা সতর্ক হলেও প্রাণহানি কমবে, হ্রাস পাবে পঙ্গুত্বের বোঝা।