এ হত্যাকাণ্ড বা হামলার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না

আজ ২১ আগস্ট। দিনটি ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ১৩তম বর্ষ। বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতির ইতিহাসে বর্বরোচিত ও কলঙ্কিত দিন। ২০০৪ সালের এইদিনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে দলটির মিছিল-পূর্ব এক সমাবেশে এ হামলা চালানো হয়। হামলার মূল টার্গেট ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী) শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। নৃশংস সেই হামলায় মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। এতে দলটির কয়েকশ নেতাকর্মী ও সমর্থক আহত হন। এ হামলার শিকার বহু লোক এখনও শরীরে ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। হামলায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও তার শ্রবণেন্দ্রীয় গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ভিন্ন আদর্শ ও ভিন্ন মত থাকবে। সেই মত জনমুখি করতে রাজনৈতিক দলগুলো সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তা তুলে ধরবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো দলকে নিশ্চিহ্ন করা বা দলটিকে নেতৃত্বশূন্য করার ষড়যন্ত্র কোনো সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারে না। হওয়া উচিতও নয়। এ হত্যাকাণ্ড বা হামলার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া যে এ ধরনের হামলা সম্ভব নয় তাও এখন স্পষ্ট। তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার এ ঘটনার পর তদন্তে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেয়নি। বরং ঘটনার পরপরই সরকারের প্রভাবশালী মহল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি বিশেষ ভবনের সম্পৃক্ততার কথা, ঘটনার পর আলামত নষ্ট করা, এফবিআই-এর তদন্ত টিমকে সহযোগিতা না করার অভিযোগ উঠেছিলো। এমনকি পরে প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে জজ মিয়া নাটকের অবতারণা করেছিলো তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই ঘটনার তদন্ত করে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করে দুটি পৃথক মামলা দায়ের করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আদালত এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। পুনর্তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আরও কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে একটি সম্পূরক চার্জশিট আদালতে জমা দেয়া হয়। চার্জশিটে অভিযুক্ত হিসেবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লৎফুজ্জামান বাবর, ৪ দলীয় জোট সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর মহাসচিবসহ ৩০ জন। ফলে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে। ২০১১ সালের আগস্ট মাসে পলাতকদের বিরুদ্ধে আদালত দেশের জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। বর্তমানে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণসহ আইনি প্রক্রিয়ার সব কার্যক্রম শেষ, আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষীপর্ব চলছে। বলা যায় এই পর্ব শেষে রায় প্রকাশের অপেক্ষা। আদালত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরই এই রায় ঘোষিত হতে পারে। ২১ আগস্টের নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের বিচারের রায় দ্রুত প্রত্যাশা করে দেশবাসী।

যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন তাদের উচিত দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে দ্রুত এই বর্বরোচিত হামলার বিচারকাজ সম্পন্ন করা। এ হামলার নেপথ্যে কারা ছিলো, হামলার উদ্দেশ্য কি ছিলো, হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড কোথা থেকে এসেছে এবং এই ঘটনায় তৎকালীন সরকারের সম্পৃক্ততা এসব তথ্য এখন অনেকটাই স্পষ্ট এবং সবাই কমবেশি অবহিত। সুতরাং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। এ ধরনের বর্বর ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক এই প্রত্যাশা সবার। দেশে গণতন্ত্র বিকাশের জন্য সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার প্রয়োজন। বোমা বা গ্রেনেড দিয়ে কাউকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। এ ধরনের অপরাজনীতিতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে না। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে কলুষিত করেছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় প্রকাশ এবং অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হোক।