ধর্মগুরু ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত : সহিংসতায় নিহত ৩১

কারফিউ জারি : দিল্লিতে ট্রেনে আগুন : উচ্চ সতর্কতা

মাথাভাঙ্গা মনিটর: ভারতের জনপ্রিয় ধর্মীয় গুরু ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত হওয়ায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যে সহিংসতায় অন্তত ৩১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আড়াশ শতাধিক। কারফিউ জারি করা হয়েছে। শ’ শ’ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। দিল্লিতেও ট্রেনে আগুন দেয়া হয়েছে। উচ্চ সতর্কর্তা জারি করা হয়েছে সেখানে। রাম রহিমের ভক্তরা বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালিয়েছে। আগামী সোমবার তার সাজা ঘোষণা করবে আদালত। ১৯৯৯ সালে দুই শিষ্যাকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে রাম রহিমের বিরুদ্ধে। ২০০২ সালে সিবিআই ডেরা প্রধানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।

গতকাল শুক্রবার ডেরা সচ্চা সৌদার প্রধান গুরমিত রাম রহিম সিংকে বিশেষ সিবিআই আদালত দোষী সাব্যস্ত করতেই আদলত চত্বরের বাইরে শুরু হয় প্রবল তাণ্ডব। লাঠি, বাঁশ, ইট-পাথর নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায় ভক্তরা। লাঠি চালিয়ে এবং কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে পাঁচকুলায় পুলিশ গুলি চালায়। পাঞ্জাবে দুটি রেলওয়ে স্টেশনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে রাম রহিমের অনুসারীরা। দুই রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় থানা এবং সরকারি দফতরে আগুন লাগানো হয়েছে। পাঁচকুলা, পাঞ্জাবের ভাতিণ্ডা, মনসা, মুকতাসর, ফিরোজপুরেও কারফিউ জারি করা  হয়েছে। পাঁচকুলার পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। আদালত চত্বরের বাইরে প্রবল গণ্ডগোল শুরু হয়। পুলিশের সাথে ডেরা অনুগামীদের সংঘর্ষে অন্তত ৩১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। পাঁচকুলার হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জায়গা দেয়া যাচ্ছে না। শহরে রক্তের অভাব দেখা দিয়েছে। কারফিউ জারি করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি প্রশাসন। উত্তেজিত সমর্থকরা হরিয়ানার বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করেছে। বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের গাড়ি ও সাংবাদিক-চিত্রসাংবাদিকদের ওপরে হামলা চালানো হয়েছে। পাঞ্জাব আর হরিয়ানা-দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানিয়েছেন। যদিও রাম রহিমকে পুলিশেরই গ্রেফতার করার কথা, কিন্তু অভূতপূর্ব হিংসা ছড়ানোর আশঙ্কায় তাকে নিজেদের কাছে না রেখে সরাসরি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। তাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় মুখ্য দফতরে রাখা হয়। পরে তাকে হেলিকপ্টারে চাপিয়ে কোনো দূরবর্তী কারাগারে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো।

রাম সিংয়ের দুই লাখের বেশি ভক্ত রায় ঘোষণার আগেই পাঁচকুলা শহরে জড়ো হয়েছিলো। আগামী সোমবার তার সাজা ঘোষণার কথা রয়েছে। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী আমরিন্দর সিং রাম সিংয়ের বিপুল সংখ্যক ভক্তকে পাঁচকুলায় যেতে দেবার জন্য হরিয়ানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন। দুই রাজ্যেরই রাজধানী চণ্ডীগড়। এলাকার স্কুল ও অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ট্রেন ও রাস্তাঘাট বন্ধ রয়েছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গ্রেফতারকৃতদের জন্য শহরের তিনটি স্টেডিয়ামকে অস্থায়ী জেলখানা বানানো হয়েছে। হরিয়ানা সীমান্ত সিল করে দিয়েছে উত্তরপ্রদেশ এবং দিল্লির পুলিশ। কিন্তু তা সত্ত্বেও দিল্লিতে অশান্তি ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করা যায়নি। উত্তরাখণ্ড থেকেও অশান্তির খবর পাওয়া গেছে।

সোমবার সাজা ঘোষণার পর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে এই আশঙ্কায় গতকাল সকাল থেকেই পাঁচকুলাকে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে মুড়ে ফেলা হয়। নামানো হয় সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবার রাত থেকে পাঁচকুরায় হাজার হাজার সমর্থক এসে হাজির হয়েছিলো। গতকাল সকাল হতেই ডেরার অনুগামীরা আদালতের বাইরে হাজির হয়। ধর্মগুরুর সমর্থনে স্লোগান দিতে থাকে। আদালতে হাজিরা দিতে ১শ’ গাড়ির বহর নিয়ে দুপুর ১টা নাগাদ আদালতে আসেন রাম রহিম। এর আড়াই ঘন্টা পর তাকে দোষী সাব্যস্ত করার রায় ঘোষণা করা হয়। এর কয়েকদিন আগে থেকেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। আদালতের রায় বাবা’র বিপক্ষে গেলে দুই রাজ্যেই আগুন জ্বলতে পারে এই আশঙ্কায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়। হরিয়ানা, পাঞ্জাব ও চন্ডীগড় প্রশাসনের যৌথ কমিটির সিদ্ধান্তে ওই তিনটি রাজ্য ও একটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে ৭২ ঘণ্টার জন্য মোবাইল ইন্টারনেট ও ডেটা পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। দু দিন চণ্ডীগড়গামী সব ট্রেন বাতিল করার জন্য রেল মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়। চণ্ডীগড় ও পাঁচকুলাগামী বাস পরিষেবা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়। পাশাপাশি ৫৩ কোম্পানি আধাসামরিক বাহিনী এবং ৫০ হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয় হরিয়ানা এবং পাঞ্জাবে।

কে এই রাম রহিম সিং? হরিয়ানা-পাঞ্জাবে অন্তত ৫ লাখ সরাসরি ভক্ত আছে গুরমিত রাম রহিমের। তাদের দাবি সারা বিশ্বে গুরু রাম রহিমের ৬ কোটি ভক্ত আছে। তিনি ডেরা সাচ্চা সৌদা নামের একটি সমপ্রদায়ের নেতা। হরিয়ানার সিরসায় তার প্রকাণ্ড হাই-টেক আশ্রম আছে। তাকে সবসময় ঘিরে থাকে সশস্ত্র ব্যক্তিগত রক্ষীর দল। শিখ, হিন্দু, মুসলিম সব ধর্মের চেতনার মিশেলেই তৈরি হয়েছে তার ধর্মীয় সমপ্রদায়। তিনি একাধারে ধর্মপ্রচারক, সমাজ সংস্কারক, গায়ক, সিনেমার নায়ক ও পরিচালক। অনেকগুলো চলচ্চিত্র তিনি তৈরি করিয়েছেন, আর সেই সব ছবিতে নিজেই নানা রকম স্টান্ট দেখান। তার আশ্রম প্রাঙ্গণে নিয়মিত বসে পপ কনসার্ট। সেখানে রাম রহিম তার তুমূল জনপ্রিয়‘ ইউ আর মাই লাভ চার্জার’র মতো অনেক গান পরিবেশন করেন। গানের ভিডিওতে পারফর্ম করার জন্য তাকে অনেকে ‘রকস্টার বাবা’ নামে অভিহিত করেন। তিনি তিনটি সিনেমা তৈরি করেছেন যেগুলো অনেক বিতর্কের পর কয়েকটি ভারতীয় ভাষায় মুক্তি পায়।

এমএসজি: ম্যাসেঞ্জার অফ গড’ এ তিনি নিজেই নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। ১৯৯৮ সালে বেগু গ্রামের একটি শিশু ডেরার জীপে চাপা পড়ে যায়। ২০০২ সালের মে মাসে ডেরা সাচ্চা সৌদার এক নারী ভক্ত গুরমিত রাম রহিমের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেনামী চিঠি পাঠান। তার একটি প্রতিলিপি পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছেও পাঠান ওই নারী ভক্ত। দু’মাসের মধ্যেই ডেরা সাচ্চা সৌদার পরিচালন সমিতির এক সদস্য রণজিত্ সিং খুন হন। পরিচালন সমিতির সদস্যরা সন্দেহ করতেন যে রনজিত্ সিংই তার বোনকে দিয়ে ওই বেনামী চিঠি লিখিয়েছিলেন। তার বোন আশ্রমের সাধিকা ছিলেন। ওই চিঠির ভিত্তিতেই হাইকোর্ট সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। ২০০২ সালে সিরসা থেকে প্রকাশিত সান্ধ্য দৈনিক ‘পুরা সচ’ (সম্পূর্ণ সত্য) এর সম্পাদক রামচন্দ্র ছত্রপতিকে গুলি করা হয়। পরে তিনি মারা যান। অভিযোগ ওঠে ডেরার দিকেই। ২০১০ সালে ডেরার সাবেক সন্ন্যাসী রামকুমার বিষ্ণোই হাইকোর্টের কাছে অভিযোগ করেন, আশ্রমের সাবেক ম্যানেজার ফকির চাঁদকে গুম ও খুন করা হয়েছে। তিনি ওই ঘটনায় সিবিআই তদন্ত দাবি করেন। রাম রহিমই ওই গুম-খুনের আদেশ দিয়েছিলেন। হংসরাজ চৌহান নামের এক ব্যক্তি ২০১২ সালে হাইকোর্টে মামলা করেন এই অভিযোগে যে ডেরা প্রধান রাম রহিমের নির্দেশে আশ্রমের ৪শ’ সাধুকে নপুংসক করে দেয়া হয়েছে।