শান্তিতে নোবেল পুরস্কার এবং মানবতার লজ্জা

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চলছে, জাতিগত নিধনযজ্ঞ চলছে এসব কথা এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব বলছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিয়ানমারের বর্তমান হত্যাযজ্ঞকে এথনিক ক্লিনজিঙের টেক্সটবুক এক্সামপল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ পাঠ্য বইয়ে জাতিগত নিধনযজ্ঞের বর্ণনায় আদর্শ উদাহরণ হতে পারে এটি। এর আগে ওআইসি মহাসচিবসহ অনেকেই একে গণহত্যার শামিল বলে উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনীর এই নিষ্ঠুর অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাজ্য ও সুইডেন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু টনক নড়ছে না মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির কিংবা সেখানকার সেনানায়কদের। তারা লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলছে। রোহিঙ্গারা নিজেরাই নাকি তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগাচ্ছে। অথচ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বলছেন, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া এবং নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ পলায়নরতদের গুলি করে মারার তথ্য-প্রমাণ ও স্যাটেলাইট চিত্র তাদের হাতে রয়েছে। বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রতিনিধি জোনাথন হেড বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে পুলিশের সামনেই রাখাইন বৌদ্ধদের আগুন লাগাতে এবং লুটপাট চালাতে তিনি নিজে দেখেছেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের এর চেয়ে বড় অপমান আর কী হতে পারে?

রোহিঙ্গারা শ শ বছর ধরে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বসবাস করে আসছে। আগে এর নাম ছিলো আরাকান। ষাটের দশকে সামরিক শাসন আসার আগে পর্যন্ত মিয়ানমার পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বও ছিলো। সত্তরের দশকে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয় এবং তার পরপরই শুরু হয় দেশটি থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন ও নিধনযজ্ঞ। নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে থাকে। প্রথম রোহিঙ্গাদের বড় ঢেউ আসে ১৯৭৮ সালে। ১৯৯২ সাল নাগাদ চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। অত্যাচার, নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হয়ে পালিয়ে আসার এ প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবরে আসে আরো প্রায় এক লাখ। সম্প্রতি সেনা অভিযানের কারণে এসেছে প্রায় আরো তিন লাখ। অর্থাৎ মিয়ানমারে থাকা ১০ লাখ রোহিঙ্গার তিন-চতুর্থাংশকেই তারা দেশছাড়া করেছে। বিশ্ববিবেক কি এর পরও চুপ করে থাকবে? থাকবে না কিংবা থাকতে পারে না বলেই আজ বিশ্ববিবেক কিছুটা হলেও সরব হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের একচোখা শাসকগোষ্ঠীর তাতে টনক নড়ছে না। তাই তাদের বাধ্য করতে হবে অবিলম্বে নিধনযজ্ঞ বন্ধ করতে।

শুধু বিশ্বের প্রতি তাকিয়ে থাকলেই হবে না, যেহেতু বিপুল শরণার্থী নিয়ে আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি, তাই নিজের গরজেই আমাদের বৈশ্বিক ফোরামে আরও সরব হতে হবে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী শরণার্থী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে যাতে ফিরিয়ে নেয়া হয়, সে লক্ষ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে।