চালের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা

 

সচিবালয়ে সরকারের তিন মন্ত্রীর সাথে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের বৈঠক

স্টাফ রিপোর্টার: আগামী কয়েক দিনের মধ্যে চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা কমানোর আশ্বাস দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে এজন্য তারা সরকারের কাছে চাল আমদানি ও পরিবহনে পাটের বস্তার পরিবর্তে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছেন। সেই সাথে স্থলবন্দর দিয়ে চালবাহী ট্রাকগুলো যাতে দ্রুত আসতে পারে, সে ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন। এসব সমস্যার সমাধানের আশ্বাস পেয়ে চালের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল মঙ্গলাবার সচিবালয়ে সরকারের তিনজন মন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিশেনের সাধারণ সম্পাদক কেএম লায়েক আলী বলেন, কাল (আজ) থেকে চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা করে কমে যাবে। চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে চালকল মালিক, আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এই সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকের শুরুতে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দেশে চালের কোনো সঙ্কট নেই এবং সারাদেশে প্রায় এক কোটি টন চাল আছে এ মন্তব্য করে ব্যবসায়ীরা কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ তোলেন। সাথে সাথে ব্যবসায়ীরা এর প্রতিবাদ জানিয়ে উল্টো সরকারের নানা নীতির সমস্যা ও সময়মতো সিদ্ধান্ত না নেয়ার কারণেই সঙ্কট তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন।

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দেশে এক কোটি টন চাল মজুত আছে জানিয়ে অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ীরা মোটা চাল মেশিন দিয়ে কেটে মিনিকেট বানান। ব্যবসায়ীরা তার এ বক্তব্যেরও প্রতিবাদ করেন। চালকল মালিক চিত্ত মজুমদার বলেন, ‘আপনার মতো একজন সিনিয়র মন্ত্রীর কাছে আমরা এ ধরনের মন্তব্য আশা করি না। কোথায় এক কোটি টন চাল মজুত আছে, আমাদের দেখান।’ এরপর ব্যবসায়ীরা একে একে চালের দাম বাড়ার কারণগুলো তুলে ধরেন।

দিনাজপুরের জহুর অটো রাইস মিলের মালিক আবদুল হান্নান নিজেকে সরকারদলীয় সমর্থক পরিচয় দিয়ে বলেন, চালের আমদানি শুল্ক কমাতে গিয়ে অনেক সময় নেয়া হয়েছে। ধাপে ধাপে কমানো হয়েছে। এসব কারণে দাম বেড়েছে। চিত্ত মজুমদার বলেন, ‘সরকার ভারত থেকে বেশি দামে চাল আমদানি করছে। কিন্তু আমাদের যদি দায়িত্ব দিত, তাহলে আমরা সরকারের চেয়ে কম দামে ভারত থেকে চাল এনে দিতে পারতাম।’

সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমি যখন খাদ্যমন্ত্রী ছিলাম, তখন ভারত থেকে চাল আমদানি করতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। মাত্র পাঁচ লাখ টন চাল আনার চুক্তি করেও কোনো চাল আনতে পারিনি। পরে ভিয়েতনাম থেকে চাল এনে সঙ্কট মোকাবিলা করেছি।’

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ব্যবসায়ীদের চালের দাম কমানোর অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘সরকার নিজেও আমদানি করে মজুত বাড়াচ্ছে। আগামীকাল (আজ) থেকে ৫০ লাখ মানুষকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি স্থগিত করেছি। আগামীকাল থেকে সারাদেশের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ওএমএস (খোলা বাজারে চাল বিক্রি) কর্মসূচি চালু করছি।’

সাংবদিকদের উপস্থিতেতে সোয়া দু ঘণ্টা আলোচনার পর চাল ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তোফায়েল বলেন, বাধা দূর করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে সাথে নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। চাল আমদানি, উৎপাদন ও সরবারহে আগামী তিন মাস চটের বস্তার পরিবর্তে প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, যে যেভাবে আনতে পারেন চাল আনবেন, প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার দুই তিন মাসের জন্য রিল্যাক্স করে দিয়েছি। যেভাবে চাল আনতে পারেন আনেন, কেউ বাঁধা দেবে না। এছাড়া ভারত থেকে ট্রেনে করে রোহনপুর দিয়ে চাল আনার জন্যও পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। দুই দফা বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি চালের মজুদ তলানিতে নেমে আসার প্রেক্ষাপটে সরকার গত অর্থবছরের শেষ দিকে চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়। সেই সাথে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি উৎসাহিত করতে ২৬ শতাংশ থেকে শুল্ক নামিয়ে আনা হয় দুই শতাংশে।

সরকারি-বেসরকারি পর্যায় মিলিয়ে গত আড়াই মাসে রেকর্ড পরিমাণ চাল আমদানি হলেও বাজারে চালের দাম বাড়ছে, যার পেছনে মিল মালিকদের কারসাজিকে দায়ী করে আসছে সরকার। সরকারি হিসেবেই মোটা চালের দাম গত এক মাসে বেড়েছে ১৮ শতাংশ, এক বছরে বেড়েছে ৫০ শতাংশ। এখন বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো মোটা চাল নেই। ধারাবাহিকভাবে চালের দাম বৃদ্ধির মধ্যে মজুদদারি বন্ধে প্রশাসন গত সপ্তাহে বিভিন্ন রাইস মিলে অভিযান শুরু করে। কুষ্টিয়ার খাজানগরে বাংলাদেশ চালকল মলিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদের চালকলে অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করা হয়। কিন্তু রশিদকে জরিমানা করার পর এ কদিনে মিনিকেট চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৪শ টাকার মতো বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অন্যান্য চালের দাম। চালকলগুলোতে অভিযান চালাতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়ার প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠকে বলেন, এখন যেহেতু আপনাদের সাথে বৈঠক হলো, তাই আমি সংশ্লিষ্টদের বলছি, এখন যাতে কোনো ব্যবসায়ী হয়রানীর শিকার না হয়। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে চাল পরিবহনে বিভিন্ন সমস্যা দূর করতেও সরকার পদক্ষেপ নেবে বলে আশ্বাস দেন বাণিজ্য মন্ত্রী। তার এ বক্তব্যের পর সভাকক্ষে উপস্থিত বেশ কয়েকজন চাল ব্যবসায়ী বলেন, দুই এক দিনের মধ্যেই চালের দাম কমতে শুরু করবে। বৈঠকের পর বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিশেনের সভাপতি আব্দুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ভালো একটি বৈঠক হয়েছে। দু’এক দিনের মধ্যেই চালের দাম কমতে শুরু করবে।