আর কতোটা প্রাণ ঝরলে ভাঙবে কর্তাদের কুম্ভঘুম?

না, না, না, কোনোভাবেই এসব মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। সরকারি হাসপাতালে সাপের বিষ পানি করা ভ্যাকসিন থাকবে না, সেই এন্টিস্নেক ভেনম পাওয়ার ক্ষেত্রে হাসপাতাল এলাকার রাতে খোলা রাখা ওষুধের এক দোকানি মেলে ধরবেন অমানবিক অবায়ব। এসব কি কোনো দায়িত্বশীল সভ্য সমাজের চিত্র? কর্তব্যরতদের উদাসীনতার কারণে পুরো সমাজটাই যে দশাগ্রস্ত তা অস্বীকার করবেন কীভাবে?
অপচিকিৎসা রোধে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে সুচিকিৎসা। চুয়াডাঙ্গায় সাপে কাটা রোগী ওঝা কবিরাজের আখড়া-আস্তানায় নেয়ারই প্রচলন ছিলো। সেটা যে অপচিকিৎসা তা বোঝাতে পত্রপত্রিকায় প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসকেরও নানামুখি উদ্যোগ আন্তরিকতা ছিলো। সাপ নিয়ে খেলতে গিয়ে ওঝাও যখন সর্পদংশনের শিকার হন, তিনিও তখন তাকে হাসপাতালে নেয়ার আকুতি জানান। চুয়াডাঙ্গা সদর আধুনিক হাসপাতালে এরকম বেশ ক’জন ওঝা চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। শুধু সাধারণ নারী-পুরুষ শিশু-কিশোর কিশোরীকেই নয়, ওঝাকেও যদি বিষধর সাপে দংশন করে আর বিষ প্রয়োগ করে তাহলে তাকে ওঝাদের ওস্তাদের নিকট নিয়েও লাভ হয় না। সাপে কাটা রোগী নিয়ে যারা ঝাড়ফুঁকের নাটক করেন তারাও বিষয়টি জানেন। তারপরও নাটক করেন মূলতঃ যদির ওপর ভর করে। বিষধর নয়, কিংবা বিষ প্রয়োগ করেনি দংশিত রোগীকেই শুধু ওরা বাঁচাতে পারে। তাতেই বাড়ে জারিজুরি। বিষয়টি যারাই জেনেছেন তাদেরই রোগী দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে সুস্থ করা সম্ভব হয়েছে। অথচ বছরখানেক ধরে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের চিত্রটা পাল্টে গেছে। যদিও সাপে কাটা রোগীর চুয়াডাঙ্গা সদর আধুনিক হাসপাতালে সুচিকিৎসা দেয়ার গৌরব খুব বেশি দিনের নয়। এইতো কয়েক বছর আগের ঘটনা। তখন বর্তমানের আবাসাকি মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন ডা. শামীম কবির। ঘটনাক্রমে তিনি একদিন হাসপাতালের ওষুধাগারের দায়িত্ব পেয়ে দেখেন বহুপদের ওষুধ রয়েছে। তাতে পড়েছে ধুলোর আস্তরন। ভাবেন, রোগীদের তো অনেক ওষুধই দেয়া হয় না, অথচ বছরান্তে বহু ওষুধপথ্য মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে বিনষ্ট করতে হয়। দেখিতো এসব ওষুধ কোন রোগের। এই দায়িত্ববোধটুকুই চুয়াডাঙ্গা সদর হাসাতালের জন্য বয়ে আনে সাপে কাটা রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার গৌরব। অথচ এর আগে সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে নেয়া হলেই রেফার করা হতো হয় খুলনা না হয় রাজশাহী। অতোদূর নেয়ার বদলে নেয়া হতো বেলগাছি কিংবা অন্য কোনো গ্রামের হাতুড়ে ওঝা কবিরাজের কাছে। যারা সনাতন পদ্ধতিতে চিকিৎসার নামে বিষপ্রয়োগের শিকার রোগীর অনিবার্য হয়ে ওঠে মৃত্যু।
চুয়াডাঙ্গা সদর আধুনিক হাসপাতালটিই শুধু একমাত্র জেলার সরকারি হাসপাতাল নয়। সাপের বিষ নিষ্ক্রীয় করা তথা পানি করার ভ্যাকসিন তো সব সরকারি হাসপাতালেই রাখার কথা। জেলা সদরে না থাকলে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকেও তো নেয়া সম্ভব। না, জেলার স্বাস্থ্যকর্তাদের সেদিকে তেমন তাগিদ নেই। এক দেড় বছর ধরে চুয়াডাঙ্গা সদর আধুনিক হাসপাতালে এন্টিস্নেক ভেনম না থাকলেও বিশেষ উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। তবে কি হাসপাতাল এলাকার ওষুধের ব্যবসায়ীদের সাথে যোগসাজোশে এন্টিস্নেক ভেনম আনা হচ্ছে না? প্রশ্নটা যেমন অমূলক নয়, তেমনই বাইরের এন্টিস্নেক ভেনমের কি গুণগত মান নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্ন সঙ্গত। বাইরে থেকে টাকা দিয়ে কেনা এসব ভ্যাকসিন দিয়ে একজন রোগীকেও কি সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়েছে? চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তির পর বেশ ক’জন রোগীর মৃত্যু অবশ্যই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে নিলেই তাকে এন্টিস্নেক ভেনম দেয়া হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে প্রথমে পর্যবেক্ষণ করা হয়। তারপরই প্রয়োজন হলে দেয়া হয় ভ্যাকসিন। অন্যথায় মানসিকভাবে সুস্থ করেই বাড়ি ফেরত পাঠানো হয়। সে হিসেবে সম্প্রতি যে সকল রোগীর এন্টিস্নেক ভেনম দেয়া হয়েছে তাদেরই তো শেষ রক্ষা হয়নি। ফলে ওষুধের দোকেন বিক্রি করা ভ্যাকসিনেরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার নয়কি? শুধু তাই নয়, যে ওষুধের দোকানে এন্টিস্নেক ভেনম নেই অথচ ওই দোকানি প্রকৃত সত্যটা গোপন করে নগদ টাকার জন্য চাপাচাপি করতে লাগলেন। মোটরসাইকেল বন্ধক রেখে ওষুধ নিয়ে আনার অনুরোধ জানালেও দোকানির সাড়া মেলেনি। অথচ নগদ টাকা তুলে দেয়ার পর দেখা গেছে পাশের দোকানিকে ডেকে তুলে ওই ওষুধ নিয়ে দিচ্ছেন। কেন? তিনি কিছু টাকা কমিশন পাবেন। মাঝরাতে কমিশন পাওয়ার জন্য একজন রোগীকে কি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া কোনো মানুষের কাজ? অবশ্য দিনের বেলায় একই এলাকার এক ওষুধের দোকানিকে কোনো কিছু বন্ধক নিয়ে নয়, মুখের কথা বিশ্বাস করেই দূরের রোগীর লোকজনকে এন্টিস্নেক ভেনম তুলে দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। সাপে কাটা রোগীর একের পর এক মৃত্যু ও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার বেহালদশা দেখে আতঙ্ক ছড়ানো খুবই স্বাভাবিক। ছড়িয়েছেও। আতঙ্কগ্রস্তদের মধ্যে যারা গণহিস্ট্রোরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদেরকে ওঝা কবিরাজের নিকট নিয়ে কাটাছেঁড়া আর ঝাড়ফুঁকের নাটক হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের হারানো গৌরব ফেরাতে বর্তমানে কর্তব্যরত জেলার সিভিল সার্জন ও আবাসিক মেডিকেল অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক হতে হবে। বিষধর সাপের উপদ্রব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের সব সরকারি হাসপাাতালে সাপে কাটা রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য অবশ্য কর্তাদের কুম্ভকর্ণঘুম ভাঙা দরকার।