খাদ্য সঙ্কট ও হামলা আতঙ্কে আবারও রোহিঙ্গা ঢল

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে জাতিসংঘ

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশে প্রবেশের উদ্দেশে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় জড়ো হয়েছে। দেশটির গণমাধ্যম গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছে, খাদ্য সঙ্কট ও ফের হামলার আশংকায় দেশত্যাগী রোহিঙ্গাদের মিছিলে যুক্ত হচ্ছে তারা।

গত ৫ সপ্তাহে ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই সংখ্যা আবারও বাড়তে শুরু করেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনে মিয়ানমারের প্রস্তাবের প্রায়োগিক দিক নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যের অর্ধেক রোহিঙ্গা পালিয়েছে। যেসব এলাকায় চরম নশৃংসতা  ঘটেনি, সেসব অঞ্চলের গ্রামের বাসিন্দারাও নিরাপত্তা-হীনতায় ভুগছে।  রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ২৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানকে জাতিসংঘ ‘জাতিগোষ্ঠী শুদ্ধিকরণ’ অভিযান বলে আখ্যায়িত করেছে।

রাষ্ট্রের সহায়তাপুষ্ট গ্লোবল নিউ লাইট অব মিয়ানমার পত্রিকা মঙ্গলবার খবর প্রকাশ করে, বাংলাদেশে প্রবেশের লক্ষ্যে লেটফয়েকিয়া ও কুনথিপিন গ্রাম থেকে দশ হাজারের বেশি মুসলমান জড়ো হয়েছে। রোহিঙ্গাদের একটি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার। সরকার তাদেরকে ‘মুসলমান’ বা ‘বাঙালি’ হিসেবে বর্ণনা করছে। বলছে তারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। কর্তৃপক্ষ পলায়নরত রোহিঙ্গাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে। রাখাইন এখন নিরাপদ বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে রাখাইনে সহিংসতায় ভাটা পড়েছে। যদিও সেনাবাহিনী সেখানে গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছে না।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও শত্রুভাবাপন্ন রাখাইন গোষ্ঠীর মাঝখানে আটকে পড়া রোহিঙ্গারা এখনো ভয় ও আতংক রয়েছে। ত্রাণসংস্থাগুলোর নাগালের বাইরে তারা। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) জানিয়েছে, স্বল্পসময় একটি স্থিতিবস্থা থাকলেও এখন প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম এএফপিকে জানান, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে থাকতে চাচ্ছে না। তারা এখানে আসতে চায়। তাদেরকে চলে যেতে বলা হচ্ছে।

রাখাইনে খাদ্যও ফুরিয়ে আসছে। গ্রামের লোকজন ভয় পাচ্ছে জমিতে চাষাবাদ করতে। যদি তাদের ওপর প্রতিবেশীরা হামলা করে। রোহিঙ্গা এডভোকেসি গ্রুপ আরাকান প্রজেক্টের ক্রিস লেবা এএফপিকে জানান, কিছু গ্রামে রোহিঙ্গারা রাখাইন গ্রামের পাশ দিয়ে যেতেও ভয় পায়। তিনি আরো বলেন, পরিস্থিতি এমন যে রোহিঙ্গা গ্রাম প্রধান যখন গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে পুরো গ্রামের বাসিন্দা তাকে অনুসরণ করছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুরো গ্রাম খালি হয়ে যাচ্ছে।

মিয়ানমার বেশিরভাগ রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করেছে। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির জনগণও চায় না তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। মিয়ানমার সরকার সতর্কতার সঙ্গে মুসলিমগোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণা গড়েছে। ইসলামের ভিত্তিতে তাদেরকে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের পথ দিয়ে আসা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে অভিহিত করছে।

মিয়ানমারের  স্টেট কাউন্সেলর দফতরের মন্ত্রী সোমবার বাংলাদেশ সফর করে বলেছেন, ১৯৯০ সালের চুক্তির ভিত্তিতে যাচাইয়ের মাধ্যমে তার সরকার শরণার্থীদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, ওই চুক্তির আওতায় ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন হয়েছে। ওই মন্ত্রী শুধুমাত্র গত বছর থেকে যারা এসেছে তাদেরকে ধরেছেন; কিন্তু এর আগের ৩ লাখ রোহিঙ্গা সর্ম্পকে কিছু বলেননি।

রোহিঙ্গারা ভীষণ ভীত হয়েও পড়ছে। মিয়ানমারে তাদের সামনে কী অপেক্ষা করছে এ চিন্তায়। বাংলাদেশের জনাধিক্য শিবিরগুলোতে ডায়রিয়া মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া রোধে সংগ্রাম চলছে। ডায়রিয়া রোগীদের জন্য কুতুপালং শিবিরে ২০ শয্যার একটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে গত সোমবার। ৬০ জনের সুবিধাসংবলিত আরো একটি ক্লিনিক এই সপ্তাহে স্থাপন করা হবে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মুখপাত্র এন্দ্রেজ মাহেকিক বলেন, ডায়রিয়া ও ভয়ানক মাত্রার পানিশূন্যতা রোগীসহ ডায়রিয়াজনিত রোগী ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘ বলছে, তারা ৪৩০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা চাইবে শিবিরে কার্যক্রম পরিচালনায়।

মিয়ারমারে ফেরত পাঠানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে জাতিসংঘ: চট্টগ্রাম অফিস জানায়, জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক ও জরুরি ত্রাণ সমন্বয়ক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি মার্ক লৌকক বলেছেন, ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য মাসে গড়ে ১৫ মিলিয়ন ডলারের ত্রাণ দরকার। দেড় লাখ নারী-শিশুর জন্য জরুরি ভিত্তিতে পুষ্টিকর খাবার দরকার। ৩ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গার জন্য জরুরি ভিত্তিতে স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা দরকার। গতকাল দুপুরে কক্সবাজারের একটি আবাসিক হোটেলে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।

এ সময় রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন তুলে ধরেন ইউনিসেফের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর অ্যান্থনি লেক। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ারমারে ফেরত পাঠানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে জাতিসংঘ। তবে যতদিন রোহিঙ্গারা যাচ্ছে না ততদিন তাদের মৌলিক অধিকার পূরণে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘ এক হয়ে কাজ করবে। সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়, নতুন আসা রোহিঙ্গারা ৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার জায়গা দখল করে আশ্রয় নিয়েছে। যা  ৮৮৯টি ফুটবল মাঠের সমান।

জাতিসংঘের এই দুই প্রতিনিধি বলেন, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬০ ভাগ শিশু। এদের মধ্যে আবার ৩০ ভাগের বয়স ৫ বছরের নিচে। আর ৭ ভাগের বয়স ১ বছরের নিচে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৩ ভাগ নারী সন্তানসম্ভবা। আর ৭ ভাগ নারী নবজাতক শিশুর মা। প্রতি ৫টি পরিবারের মধ্যে একটিতে কোন পুরুষ না থাকায় নারীদেরকে সবকিছু সামলাতে হচ্ছে। আবার ৫ ভাগ পরিবার শিশুপ্রধান। ওইসব পরিবারে ত্রাণ জোগাড় করাসহ বিভিন্ন কাজ করছে শিশুরাই। ২ লাখ রোহিঙ্গা শিশুই কোন শিক্ষার আলো পায়নি। অর্ধেক রোহিঙ্গার জন্যই স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ দরকার।