মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির শুনানি : আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের আশঙ্কা

স্টাফ রিপোর্টার: মিয়ানমারে মার্কিন সহায়তা বন্ধ ও নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেশটির সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রতিনিধিরা। তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা নিধন অপরাধে জড়িতদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। গতকাল শুক্রবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা  গেছে।

এদিকে রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ক এ শুনানিতে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের কারণে স্থানীয়ভাবে অস্থিতিশীলতা তৈরি ও একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ উত্থানের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে বলে বার্তা সংস্থা এপি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর হামলা বন্ধ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির এক শুনানিতে দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের ভারপ্রাপ্ত উপমন্ত্রী প্যাট্রিক মার্ফি বলেন, ‘আমরা এমন কিছু করতে চাই না যাতে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা বেড়ে যায়। আমরা পরিস্থিতি জটিল করতে চাই না।’ কমিটির ডেমোক্রেটদের শীর্ষনেতা এলিয়ট অ্যাঞ্জেল বলেন, ‘ওয়াশিংটনের উচিত মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনীর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিলকরণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা।’ এছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যাওয়ার সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে কমিটির পক্ষ থেকে।

২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযানের মুখে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এই নিপীড়নকে জাতিসংঘ ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ হিসেবে উল্লেখ  করেছে। তবে মিয়ানমার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে তারা। এই সহিংসতা শুরু হওয়ার পর প্যাট্রিক মার্ফি মিয়ানমার সফর করেছেন।

রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির রিপাবলিকান চেয়ারম্যান এড রয়েস বলেছেন, ‘সু চি জাতিগত নিধনযজ্ঞের কথা অস্বীকার করলেও বিষয়টি সত্য। এটা নিয়ে তার কথা বলা উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই অপরাধে জড়িতদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। এটা অবশ্যই জাতিগত নিধনযজ্ঞ।’

রিপাবলিকান প্রতিনিধি স্কট পেরি বলেন,‘আমরা এখানে শাদা শার্ট ও স্যুট পরে বসে আছি। আর ওখানে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে ও দেশ থেকে বিতাড়ন করা হচ্ছে। কাউকে না কাউকে পদক্ষেপ নিতেই হবে।’ এ সময় মার্ফি জানান, ‘এই মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’ ফরেন কমিটি প্যানেলের এশিয়া সাব-কমিটির চেয়ারম্যান টেড ইউহো প্রশ্ন তুলেন, রাখাইনে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের তদন্তের অনুমতি দেয়ার আগ পর্যন্ত মিয়ানমারে মার্কিন সহায়তা বন্ধ করলে তা কার্যকর হবে কিনা। হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মার্কিন সংস্থা ইউএসএইড-র কেট সোমভংসিরি জানান, বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, পরিস্থিতির ভয়াবহতায় আমাদের অবশ্যই সবগুলো উপায় বিবেচনায় রাখতে হবে।

প্রসঙ্গত, রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ মারছে। রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। তবে এত কিছুর পরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ থামছে না। প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকছে বলে জানা গেছে।

আরো রোহিঙ্গা ঢলের শঙ্কা জাতিসংঘের: এদিকে মিয়ানমারের সন্ত্রাস কবলিত রাখাইন রাজ্য থেকে আরও বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। গতকাল শুক্রবার জেনেভায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সংস্থার মানবিক ও জরুরি ত্রাণ বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক লোকক এই আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসা এখনও থামেনি। এখনও মিয়ানমারে হাজার হাজার রোহিঙ্গা রয়ে গেছে। আবারো বড় আকারের রোহিঙ্গা ঢলের জন্য আমরা প্রস্তুতি নিতে চাই। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে জাতিসংঘের একটি উচ্চপর্যায়ের টিম মিয়ানমারে যেতে সমর্থ হবে। তিনি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে রাখাইনে নির্বিঘ্নে প্রবেশের অনুমতি প্রদানের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি  আহ্বান জানান।

অপুষ্টি ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রোহিঙ্গা শিশুরা: বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে ৫ বছরের কমবয়সী ১ লাখ ৪৫ হাজার শিশু অপুষ্টির ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ডিজাস্টার্স ইমারজেন্সি কমিটি (ডিইসি)। সংস্থাটি ‘দ্য ইন্ডেপেনডেন্ট’কে জানায়, এসব শিশুদের মধ্যে কমপক্ষে ১৪ হাজার শরণার্থী শিশু ইতিমধ্যে তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। এছাড়া ৫০ হাজারেরও বেশি  অন্তঃসত্ত্বা ও দুগ্ধপোষ্য শিশুর মা-এমন রোহিঙ্গা নারীর জন্য সুষম খাদ্যের প্রয়োজন রয়েছে।

এছাড়া এসব শিশুরা ডায়রিয়া ও কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। গতকাল জেনেভায় এক সংবাদ সন্মেলনে সংস্থাটি এ তথ্য জানায়। ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশে আসা ৫ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য কোন পরিকল্পিত আবাস নেই। পানি, স্যানিটেশন সমস্যাও রয়েছে। গত সপ্তাহে ৫ হাজার ডায়রিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে। ২৫ আগষ্ট থেকে এখন পর্যন্ত  কক্সবাজারে নতুন-পুরনো রোহিঙ্গা শিবিরে  ৩শ’ নলকূপ ও ৩ হাজার টয়লেট তৈরি করা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে টাকা আদায়, ১১ জনের জেল: ইত্তেফাকের টেকনাফ (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, টেকনাফে ১১ দালালকে ভ্রাম্যমাণ আদালত কারাদন্ড প্রদান করেছে। শুক্রবার বিকেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিকের আদালতে এ দণ্ড প্রদান করা হয়। রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে টাকা আদায়ের অপরাধে এদের প্রত্যেককে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড  দেয়া হয়েছে। টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন খাঁন সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।