বৃক্ষের প্রায় সব বীজই বৃক্ষ হওয়ার ক্ষমতা রাখে, তবে………..

সম্পাদকীয়-১

এক সময় পিটিয়ে পড়তে বসানোই দস্তুর ছিলো, এখন বেত্রাঘাত দূরাস্ত লাঠি নিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশও শিক্ষকের জন্য দ-নীয়। তারপর কি এমন হলো যে, চুয়াডাঙ্গা মাখালডাঙ্গার কওমি মাদরাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র কিশোর সাব্বির আহমেদ মাদরাসায় যেতে নারাজ। সে মরতে রাজি মাদরাসায় যাবে না। জোর জবরদস্তির একপর্যায়ে সে অতোটুকু বয়সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে বসেছে। তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে।
ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই আদর্শ বলা যায়, যেখানে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থিত হয়। ওই শিক্ষকই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক যার শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণে অধিক মনোনীবেশ করে। এসবের উল্টো মানেই কিছু প্রশ্ন দানা বাঁধে। তবে কি শিক্ষালয়ে শাস্তির ডেরা রয়েছে? নাকি কোনো শিক্ষকের কোনো চাহিদা পূরণে অপারগতার এমন কিছু রয়েছে যা প্রকাশও করতে পারছে না ছাত্র? একজন শিশু শিক্ষার্থীকে মেরে ধরে যখন মাদরাসায় পাঠানোর পর সে তা না গিয়ে উল্টো মায়াবি জগত ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য জীবনপ্রদীপ নেভানোর মতো কিছু করে বসে তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্দর নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অসঙ্গত নয়। তবে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করলেই চলবে না, অভিভাবকদের বিবেকবোধের বিষয়টিও খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। সন্তান কেন লেখাপড়ায় মনোনীবেশ করতে পারছে না, কেন সে অতোটা উল্টো তা না বুঝে কোথাও যেতে কি ওইভাবে বাধ্য করতে পারে কোনো অভিভাবক? উন্নত বিশ্ব হলে ওই অভিভাবককে নির্ঘাত ঢুকতে হতো গারদে ঘেরা ঘরে। ভাগ্যিস আমাদের দেশে শিশুদের ওই অধিকার যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয় না বলেই পিতা-মাতার ইচ্ছে চাপিয়ে দেয়া হয় শিশু সন্তানের ওপর। কেমন পিতা-মাতা যে তার সন্তানের পছন্দ অপছন্দ বুঝতে অক্ষম? শুধু নিজের পছন্দ চাপালে হবে না, সন্তানের পছন্দের মূল্যায়ন অভিভাকের দায়িত্ব।
বৃক্ষের প্রায় সব বীজই বৃক্ষ হওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সব বীজ কি অঙ্কুরিত হয়? ঊর্বর মাটি পেয়ে অঙ্কুরিত হলেও সব যেমন বৃক্ষে রূপ নেয় না, তেমনই সকল শিশুই প্রায় সমান মেধার অধিকারী হলেও সফল স্বার্থক মানুষ হয় না। কেন? বৃক্ষের বীজকে বৃক্ষে রূপান্তর হতে হলে তার যেমন দরকার উপযোগী পরিবেশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা, তেমনই একজন শিশুকেও সফল স্বার্থক মানুষ করতে হলে দরকার পরিবেশসহ পছন্দ বুঝে তার মধ্যে স্বপ্নের বীজ বুনা।
পুনশ্চঃ মাদরাসায় যেতে শিশু শিক্ষার্থীর আপত্তির প্রকৃত আড়াল উন্মোচন প্রয়োজন।

সম্পাদকীয় -২
সামান্য ভুলও সমাজের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়
সমাজের সকল শিশুর দিকে সমান দৃষ্টিতে তাকানোর পুনঃপুনঃ তাগিদ থাকলেও সাবালক হওয়ার পর তাদের সকলেই কি সমান মর্যাদার হয়? মূল্যেও ফারাক থাকে অনেক। কেন? কারণ সমাজ কারো কারো প্রতি কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করে, কেউ কেউ সেই টাকার ছিটে ফোঁটাও নিয়ে নিজেকে গড়তে পারে না। এ তারতম্যের মাহেত্ম বিষদ। যারা সমাজের উঁচু স্তরে পৌঁছুই তাদের অবশ্যই ঘাত-প্রতিঘাত বহু ঘেরাটোপ মাড়াতে হয়। নিজেকে দায়িত্বশীল অবস্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে আপনা আপনিই বোপিত হয় দায়িত্ববোধ। সমাজের কাছে কমবেশি তারাই আদর্শ বা অনুকরণীয় হয়ে ওঠেন যারা নিজেদের মূল্যবান স্তরে নিতে পারেন। এরপর তাদের সামান্য ভুলও সমাজের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তা না হলে চুয়াডাঙ্গা স্টেশনের দক্ষিণপ্রান্তের বর্হিলাইনে থামিয়ে রাখা মালবাহী রেলগাড়ির ওয়াগনের নিচ দিয়ে পার হতে গিয়ে রক্তাক্ত জখম হওয়া কোনো ব্যক্তির খবর কি পত্রিকার পাতায় অতো গুরুত্ব পায়?
চুয়াডাঙ্গা বিএডিসির একজন উপসহকারী পরিচালক। তিনি স্বাস্থ্য সচেতন। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় তিনি হাঁটতে বের হন। গতপরশু শুক্রবার সন্ধ্যায় হাঁটতে বের হয়ে বিএডিসি খামার সংলগ্ন ফার্মপাড়ার কদমতলা অরক্ষিত লেবেল ক্রসিঙে পৌঁছে দেখেন মালবাহী ট্রেনের সারিবদ্ধ ওয়াগন দাঁড়িয়ে। তিনি অন্যদের মতে মাথা নিচু করে মালবাহী ট্রেনের নিচ দিয়ে পার হতে গেলে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে রক্তাক্ত জখম হন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। সমাজের একজন নিচু দরের মানুষের ক্ষেত্রে এটা নিশ্চয় পত্রিকার জন্য তেমন খবর ছিলো না ঠিকই। খবর তখনই যখন সমাজের শিক্ষিত এবং উঁচুদরের দায়িত্বশীলদের একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করতে গিয়ে রক্তাক্ত জখম হয়েছেন তখন। তিনি প্রাণ হারাতেও তো পারতেন? তিনি নিশ্চয় জানেন, তাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য তার ইচ্ছা শক্তির পাশাপাশি অভিভাবক এবং রাষ্ট্র বা সমাজেরও অনেক টাকা খরচ করতে হয়েছে। তার অকাল প্রাণনাশ যেমন সমাজের জন্য চরম ক্ষতির কারণ হতে পারতো তেমনই তিনি একজন শিক্ষিত সচেতন মানুষ হয়েও ভুল পথে হেঁটে ক্ষতিকর প্রবণতা ছড়াতে উৎসাহিত করলেন। কারণ শিক্ষিতদের দেখেই সমাজের সাধারণ মানুষ চলতে শেখে। শিক্ষিত দায়িত্বশীলরাই তো সমাজের আদর্শ।
ঘটনাকে ঠিক নির্বুদ্ধিতা বলা চলে কি-না তা নিয়ে বিতর্ক অমূলক নয়। তবে ঘটনাটি যে অসর্তকতারই খেসারত তা নিশ্চয় রক্তাক্ত জখম কৃষিকর্তা নিজেও অস্বীকার করবেন না। সমাজের বড় বড় দায়িত্বে থাকা বহুজ্ঞানের অধিকারী, বহুগুণে গুণান্বিতরও হরহামেশাই ভুল হয়। কখনো বেখেয়ালে, কখনো গড্ডালিকায় গা ভাসানোর কারণে। কড়াব্রেকেও রেলগাড়ি বেশ কিছুটা গড়ায়। সে কারণে বাড়তি সতর্কতার বিকল্প নেই। মালবাহী রেলের সারিবদ্ধ ওয়াগন কখনো কখনো কয়েকদিন ধরে ফেলে রাখা হয়। তার মানে এই নয়, তা পার হতে নিচে বা ওপরে উঠতে হবে। চুয়াডাঙ্গা ফার্মপাড়া কদমতলা লেবেলক্রসিংটির একেতো বৈধতা নেই। তার ওপর সেখানে থামিয়ে রাখা হয় মালবাহী রেলগাড়ি। হুট করে সামান্য গড়ালেই যেখানে মৃত্যু অনিবার্য সেখানে একজন শিক্ষিতের ঝুঁকি নেয়া দূরাস্ত, অন্যদের সতর্ক করাই তার দায়িত্বের অংশ। সামান্য জখম হওয়ার মধ্যদিয়ে নিজেকে শুধরে নিয়ে তিনি নিশ্চয় সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা শিরোধার্য করবেন।