অনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি হলে প্রকৃত মেধাবীরা বঞ্চিত হয়

সমাজে যে যতো উঁচুতে ওঠে, সমাজের প্রতি তার ততোই দায়বদ্ধতা বাড়ে। আর উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলে? স্বীকৃত সনদে আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর সাথে সাথে ন্যায় অন্যায় বোঝার দৃষ্টিটাও স্বচ্ছ হওয়ার কথা। উচ্চ শিক্ষার সনদধারীর বিবেকবোধ পরিষ্কার না হলে বুঝতে হবে শিক্ষার আলোয় ঘাটতি আছে। অবশ্য অর্থলিপ্সতায় কিংবা ধর্মান্ধতায় বিবেকবোধ ভোতা হওয়ার আড়ালে অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক ও পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়টিও অস্বীকার করা যায় না। মেডিকেল ও ডেন্টালে ভর্তি পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বলে অর্থ হাতিয়ে নেয়া চক্রের উচ্চশিক্ষার সনদধারীদের নৈতিকতার স্খলনের ক্ষেত্রে ঠিক কোন বিষয়টিকে দোষারোপ করা যায়?
বেশ কয়েক বছর ধরেই মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার আগে পরে প্রশ্ন পত্র ফাঁস হওয়ার জোর গুঞ্জন উঠছে। কোনো কোনোবার পরীক্ষার্থীদের একাংশ প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ তুলে পরীক্ষা বাতিলের দাবি নিয়ে রাজপথেও নেমেছে। কাজ হয়নি। সরকারের তরফে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টিকে তেমন পাত্তাই দেয়া হয়নি, হয় না। এর সুযোগে একধরনের প্রতারকচক্র মাঠে নামে, যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দেয়ার কথা বলে কাড়ি কাড়ি টাকা, টাকার চেক হাতিয়ে নেয়। এবারও তার তেমন ব্যতিক্রম ঘটেনি। তথ্য পেয়ে ঢাকাস্থ র‌্যাব-১০’র একটি দল পরীক্ষার পূর্ব রাত থেকে শুরু করে গতপরশু রোববার দুপুর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে এক নারীসহ ৪ জনকে আটক করেছে। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, আটককৃতদের মধ্যে চুয়াডাঙ্গার একজন রয়েছেন। যিনি চিকিৎসক এবং অর্থশালী পরিবারের সন্তান। তার বিরুদ্ধে র‌্যাব-১০ যে অভিযোগ উত্থাপন করেছে তা অবশ্যই অপ্রত্যাশিত। আটককৃতদের নিকট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ওই চক্রের দেয়া কথিত প্রশ্নপত্র নেয়া বেশকিছু পরীক্ষার্থীর অভিভাবকদের দেয়া মোট ৫২টি চেক। যার মধ্যে ৬টি স্বাক্ষর থাকলেও টাকার অংক লেখা নেই। বাকি ৪৬টিতে যে টাকার অংক লেখা রয়েছে তার পরিমাণ ৩ কোটি ৫০ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এছাড়াও যেসব মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বিক্রি করা হয়েছে সেই তথ্যপ্রযুক্তির তথ্য প্রমাণও মেলে ধরেছে র‌্যাব।
আমাদের সমাজের অভিভাকদের সিংহভাগেরই স্বপ্ন তাদের সন্তান হয় প্রকৌশলী না হয় চিকিৎসক হবে। জীবন সফল ও স্বার্থক করার জন্য যে বহু ক্ষেত্র রয়েছে তা ভুলেই যান তারা। এজন্য সন্তানকে সেই শিশুকাল থেকেই পড়তে হচ্ছে মেধা প্রতিযোগিতার মধ্যে। মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি করতে পারলেই স্বল্প খরচেই সন্তান চিকিৎসক হয়ে বের হবে। আর বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টালে ভর্তি মানে মাসান্তর মোটা অংকের টাকা খরচা। সেই খরচের ঝুঁকি এড়িয়ে যদি যদি পরীক্ষার পূর্বরাতে এককালীন মোটা অংক খরচ করে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ নিশ্চিত করা যায় তাহলে কি আর অর্থশালী কোনো অভিভাবক অন্যদিকে দিকে দৃষ্টি দেন? অর্থশালীদের জন্য এরকম অনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি হলে প্রকৃত মেধাবীরা বঞ্চিত হয়। আর জাতি হারায় মেধাবী চিকিৎসক। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে দেয়া প্রশ্নপত্র যে পুরোটাই ভূয়া তাও সকলে একবাক্যে মানতে নারাজ। কেননা, ওরা যে প্রশ্ন দেয়ার বিনিময়ে চেক নেয় যখন তখন ওদের দেয়া সেই প্রশ্ন অবশ্যই ক্ষতিয়ে দেখার দাবি রাখে। যদিও এবারের মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রিক প্রাপ্য তথ্যমতে র‌্যাব-১০’র অভিযানে ধরাপড়া ৪ জনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কথা বলে ভুয়া প্রশ্ন দিয়ে প্রতারণা করে টাকা নেয়া। এ অভিযোগে মামলা হয়েছে। তদন্ত চলছে। প্রকৃত চিত্র উন্মোচিত হবে নিশ্চয়।
স্বাস্থ্য বিজ্ঞানে যারা পড়েন, তাদের অবশ্যই যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে হয়। এ শাস্ত্রে লেখাপড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পেছনে বহু অর্থ ব্যয় করতে হয়। এ ব্যয়ের অধিকাংশই বহন করে জাতি। জাতির স্বার্থেই রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ব্যয়ভার বহন করা হয়। যেহেতু চিকিৎসা পাওয়ার আশায় ব্যয়, সেহেতু জাতি শ্রেষ্ঠটাই প্রত্যাশা করে। সেটাই হওয়া উচিত। সে কারণে যোগ্যতার মাপকাঠিটাও স্বচ্ছ থাকা, রাখা জরুরি। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে কেউ সুযোগ নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাতি। ফলে প্রশ্নপত্র ফাঁস যেমন শক্ত হাতে রুখতে হবে, তেমনই প্রশ্নপত্র নিয়ে প্রতারণায় মত্ত অর্থলিপ্সুদের অপতৎপরতাও বন্ধ করতে বাস্তবমুখি পদক্ষেপ নিতে হবে। লেখাপড়া যাদের বিবেক জাগায়নি, তাদের শাস্তি দোষের কী?